দুই মাসে ট্রেনে নাশকতার আগুনে ৯ জনের নির্মম মৃত্যু

প্রকাশিত: ১০:৫১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১০, ২০২৪

# হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১০ জন

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা দেশব্যাপী অবরোধ-হরতাল কর্মসূচির দিনে ও আগের রাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ট্রেনে লাগানো নাশকতার আগুনে পুড়ে গত দুই মাসে ৯ জনের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। পৃথক এসব ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়েছেন অনেকেই। দুর্বৃত্তের লাগানো আগুনে পুড়ে ইতোমধ্যেই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন নারী-শিশুসহ ১০ জন। এরা হলেন- মো. ইকবাল (৪৮), ডেইজি আক্তার রতœা (৪০), ডা. কৌশিক বিশ্বাষ (৩২), মো. মাসুদ রানা (৩১), আসিফ মোহাম্মদ খান (৩০), নাফিস আলম (২২), দিহান (১১), রেহান (৬) ও অজ্ঞাতনামা আরও দুই নারী। চিকিৎসকরা বলছেন, তারা কেউই এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ট্রেন ও যাত্রীর নিরাপত্তায় বগিতে সিসি ক্যামেরা বসানো ও নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার (১০ জানুয়ারি) রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত কয়েক মাস ধরে অবরোধ, হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করে আসছিল। এসব কর্মসূচির দিনে বা আগের রাতে ঢাকা ও বিভিন্ন এলাকায় যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বিএনপিকে দায়ী করা হলেও বিএনপি বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ জানুয়ারি দুপুরে যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে বেনাপোল এক্সপ্রেস। ওইদিন রাত ৯টা ৫ মিনিটের দিকে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছার আগে সায়েদাবাদ এলাকা অতিক্রম করে গোপীবাগ বাজার ও গোলাপবাগ জামে মসজিদের সামনে পৌঁছালে হঠাৎ করেই ট্রেনটিতে আগুন জ্বলে ওঠে। জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায় দুই নারী, এক শিশুসহ ৪ জন। শুধু এই চার জনই নয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে গত ২৮ অক্টোবরের পর দুর্বৃত্তদের লাগানো ট্রেনে নাশকতার আগুনে গত দুই মাসে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন মোট ৯ জন।
রেলওয়ে ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির হরতালের মধ্যে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সেখান থেকে মা ও ছেলেসহ ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই দিনের প্রথম প্রহরের আগ মুহূর্তে নেত্রকোনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটের দিকে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে যাওয়ার পথে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছে পৌঁছালে এতে আগুন দেখতে পান ট্রেন অ্যাটেনডেন্টরা। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তেজগাঁও স্টেশনের কাছে আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৯ জনকে আটক করে র‌্যাব। এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব-১ এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোশতাক আহমেদ বলেছেন, আটককৃতদের রেলস্টেশন ও রেললাইন সংলগ্ন এলাকায় অপরাধের রেকর্ড আছে। তারা কোনো মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সামান্য অর্থের বিনিময়ে নাশকতামূলক কর্মকান্ড করে থাকে।
এদিকে গত ১৫ ডিসেম্বর মধ্য রাতে জয়পুরহাটে উত্তরা এক্সপ্রেস মেইলের চলন্ত ট্রেনের একটি বগিতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে ট্রেনের একটি বগির কয়েকটি আসন পুড়ে যায়। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। গত ১৪ ডিসেম্বর নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ৭২টি ক্লিপ খুলে নাশকতার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। তবে এলাকাবাসী সেটা আগেই দেখতে পাওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি। গত ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের ভাওয়ালে রেললাইন কেটে নাশকতা চালায় দুর্বৃত্তরা। রাজেন্দ্রপুর স্টেশন ছেড়ে আসে ঢাকামুখী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় একদিন ধরে ওই লাইনে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়েছিল। দুর্ঘটনার পর গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, এটা সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়। নাশকতার উদ্দেশ্যে রেললাইন কেটে রাখা হয়। আমরা ঘটনাস্থলে এসে গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছি। রেললাইন কাটার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করেছে দুর্বৃত্তরা। গত ১৬ নভেম্বব টাঙ্গাইল রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কমিউটার ট্রেনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনের দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগে গত ২৭ নভেম্বর রাতে পাবনার ঈশ্বরদীতে একটি ট্রেনের বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে যায় ট্রেনের ১১টি বগি। এছাড়া, এর আগে ১ নভেম্বর বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে ঈশ্বরদীতে কলকাতা-ঢাকা পথে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ‘হাতবোমা’ নিক্ষেপ করা হয়। এসব ঘটনা অনুসন্ধানে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কয়েকজনকে। এরও আগে গত ১৮ নভেম্বর মধ্য রাতে জামালপুরের সরিষাবাড়ী রেল স্টেশনে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এতে ট্রেনের তিনটি বগি পুড়ে যায়। লাফিয়ে নামতে গিয়ে আহত হন অন্তত ১০ জন।
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের এসপি আনোয়ার হোসেন নিউজ পোস্টকে বলেন, গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনায় মামলা হয়েছে। ওই ট্রেনের পরিচালক (গার্ড) এস এম নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে থানায় এ মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যেই নাশকতার পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা বিএনপি নেতা নবী উল্লাহ নবীসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদের মধ্যে নবীকে ৩ দিনের রিমান্ডে এনেছে ডিবি পুলিশ।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান নিউজ পোস্টকে বলেন, ট্রেনে আগুন লাগিয়ে যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে, তারা মানবতার শত্রæ। তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনাকাঙ্খিত এসব ঘটনায় হতাহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, গোপীবাগের ঘটনার পর নাশকতা এড়াতে দেশের বিভিন্ন রুটে ৩২টি ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হয়। তবে এরই মধ্যে ট্রেন ও যাত্রীর নিরাপত্তায় রেলওয়ে পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ট্রেনে নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিতে প্রতিটি বগিতে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া ও যাত্রীদের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম নিউজ পোস্টকে বলেন, শুধু ট্রেনের আগুনই নয়, দেশের যে কোনো স্থানে যে কোনো ধরনের আগুন নির্বাপনে ও দুর্যোগ মোকাবিলায় রাত-দিন ২৪ ঘন্টাই প্রস্তুত রয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা।