কোভিড–১৯ আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। এ কারণে সন্দেহভাজন অনেকে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণাও করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ২৯টি জেলা লকডাউন (অবরুদ্ধ) করেছে সরকার। দেশে শনাক্ত হওয়া মোট রোগীর ৩৮ শতাংশের বেশি (৭০৪ জন) এসব এলাকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব এলাকা অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকায় আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের তূলনামূলকভাবে সহজে শনাক্ত (কন্টাক্ট ট্রেসিং) করা সম্ভব। তাঁদের পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে আসবে। এ ছাড়া এসব এলাকায় কারও মধ্যে লক্ষণ–উপসর্গ দেখা দিলে তাদেরও পরীক্ষার আওতায় আনার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু এসব এলাকায় রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার পরিসর সেভাবে বাড়ছে না।
পরীক্ষা কম হওয়ার বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্যেও এসেছে। গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে তিনি বলেন, রোগীরা পরীক্ষা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না এবং গোপন করে যান।
করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। গত মঙ্গলবার সংস্থাটি প্রকাশিত সবশেষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধবিষয়ক কৌশলপত্রে বলেছে, এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো টিকা বা সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। দেশগুলোকে পরীক্ষা ও শনাক্তের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, আক্রান্তদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করতে হবে।
প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, গতকাল পর্যন্ত লকডাউন হওয়া ২৯ জেলায় মোট ৭০৪ জনের মধ্যে কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এসব জেলায় হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ২৭ হাজার ৩৪৫ জন। আর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ৫৮১ জন। এর মধ্যে ১৯টি জেলায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ৩ হাজার ৮৬০ জন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা ২৫৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বাকি ১০টি জেলার কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কতজনের পরীক্ষা করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। এ ছাড়া ২৯ জেলায় আইসোলেশনে থাকা ৪৬৮ জনের মধ্যে ৪৫৪ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে
আক্রান্ত দেশগুলোকে পরীক্ষা ও শনাক্তের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ
কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের করোনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। গতকাল তিনি মুঠোফোনে বলেন, কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের নমুনা আরও বেশি করে পাঠাতে বলা হয়েছে। আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও কোয়ারেন্টিন করতে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে।
নীলফামারীতে গতকাল পর্যন্ত নয়জন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। নীলফামারীর সিভিল সার্জন রনজিৎ কুমার বর্মন বলেন, জেলায় হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৮ হাজার ৪০২ জন। তাঁদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ২০৯ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
কুমিল্লায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ জন। কোভিড–১৯ নিয়ে কুমিল্লা জেলার ফোকাল পারসন ও ডেপুটি সিভিল সার্জন সাহাদাৎ হোসেন জানান, কুমিল্লায় হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১ হাজার ৩৯০ জন। তাঁদের মধ্যে ৩২৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যাঁরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ২৬৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন মো. মাহফুজার রহমান সরকার জানান, গতকাল জেলায় ৫১২ জন হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২৫০ জনের করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা ১০০ জনের সবার করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
লকডাউন হওয়া ২০ জেলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এমন ২ হাজার ৭১৫ জনকে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৩২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বাকি ৮টি জেলায় আক্রান্ত থাকলেও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়নি।
৭ এপ্রিল প্রথম নারায়ণগঞ্জ জেলা লকডাউন করা হয়। নারায়ণগঞ্জে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৬১ জনের। তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের কাছ থেকে রোগের পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হলেও তার সুনির্দিষ্ট হিসাব জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন মো. ইমতিয়াজ বলেন, শুরুর দিকে যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের (কন্টাক্ট ট্রেসিং) চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ে আগাচ্ছে না। লকডাউনের কারণে অনেকেই ঘরে থাকছেন। তাই যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের লোকজনের করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
নরসিংদীতে গতকাল পর্যন্ত ৯১ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। জেলার সিভিল সার্জন মো. ইব্রাহীম বলেন, হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৬৭৪ জন। তাঁদের মধ্যে ৩৭৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা তিন শতাধিক ব্যক্তি বা স্বজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গতকাল পর্যন্ত ১৬ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সিভিল সার্জন মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বলেন, জেলায় ৬৪৯ জন হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। তাঁদের মধ্যে ২৪৫ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যাঁরা করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ৬২ জন বা স্বজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
করোনা সংক্রমণের নতুন উপকেন্দ্র গাজীপুর। গাজীপুরে গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ চিকিৎসকসহ ১১০ জন। সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কর্মরত সিনিয়র হেলথ এডুকেশন অফিসার মো. নুরুল ইসলাম জানান, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু লকডাউন করলে হবে না, সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের তৎপরতাও থাকতে হবে। কোয়ারেন্টিনে যাঁরা আছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ (কন্টাক্ট ট্রেসিং) আরও বিস্তৃতভাবে করতে হবে। সূত্র- প্রথম আলোক।