মোঃ সাইফুল ইসলাম :
সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজন চিফ হুইপ ও ছয় জন হুইপ নিয়োগের কথা রয়েছে বাংলাদেশের আইনে। রাষ্ট্রপতির আদেশ The Bangladesh (Whips Order 1972) অনুযায়ী, দেশের রাষ্ট্রপতি চিফ হুইপসহ অন্য ছয় জন হুইপ নিয়োগ দেন। আইনে হুইপ বলতে সরকারি দলের হুইপকেই বোঝানো হয়। বিরোধী দলের হুইপের কোনও পদমর্যাদা বা স্বীকৃতি নেই।
চিফ হুইপসহ অন্যান্য হুইপের দায়িত্ব কর্তব্য ও সুযোগ-সুবিধার কথাও বলা হয়েছে আইনে। এক্ষেত্রে চিফ হুইপ পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য হন। আর হুইপরা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসহ সমপরিমাণ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য হন।
নিয়োগ কর্তা হিসেবে রাষ্ট্রপতি যেমন হুইপদের নিয়োগ দেন, তিনি চাইলে তাদের পদ থেকে অপসারণও করতে পারেন। সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলে বা সংসদ সদস্য পদ হারালে হুইপের পদও থাকবে না।
আইন অনুযায়ী চিফ হুইপ মন্ত্রীদের সমপরিমাণ বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হন। তিনি নিজের পছন্দমতো একজন অফিস সহকারী পান।
হুইপরা পান প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ও তাদের সমপরিমাণ বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।
কাজ কী
আইনে চিফ হুইপের সুনির্দিষ্ট চারটি কাজের কথা উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে– সংসদ সদস্যদের কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা; অধিবেশনে এমপিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা; প্রতিটি বৈঠকের কার্যক্রম ঠিক করা এবং সরকার কর্তৃক অর্পিত বা নির্ধারিত অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা।
অপরদিকে আইন অনুযায়ী হুইপদের দায়িত্ব হচ্ছে চিফ হুইপ বা সরকার কর্তৃক অর্পিত বা নির্ধারিত কাজগুলো সম্পাদন করা।
আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চিফ হুইপ ও অন্য হুইপরা যে দায়িত্ব পালন করেন তার অন্যতম হলো– সংসদ সদস্যদের সংসদের বৈঠকে উপস্থিতি নিশ্চিত করা। সংসদে কোরাম সংকটের আশঙ্কা হলে আশপাশে (লবি) অবস্থানরত এমপিদের সংসদে ডেকে আনা। কোনও প্রশ্নে ভোট হলে সরকার ও বিরোধী দল উভয়পক্ষের প্রয়োজন পড়ে স্ব-স্ব পক্ষের যথাসম্ভব অধিক সংখ্যক সদস্যকে পার্লামেন্টে হাজির রাখা। হুইপরা সেই কাজটি করেন।
যেসব সুবিধা পান
একজন মন্ত্রীর মাসিক বেতন ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। প্রতিমন্ত্রীর বেতন ৯২ হাজার এবং উপমন্ত্রীর ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা। দায়িত্ব পাওয়ার পর একজন মন্ত্রী সরকারি ব্যয়ে একটি সুসজ্জিত বাসভবন পান বিনা ভাড়ায়। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীও একই সুবিধা পেয়ে থাকেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা গণপূর্ত থেকে আবাসন সুবিধা পেলেও চিফ হুইপ ও হুইপরা পান সংসদ সচিবালয় থেকে।
মন্ত্রী যদি সরকারি বাড়িতে না থেকে নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাহলে সরকার থেকে তিনি মাসিক ৮০ হাজার টাকা করে ভাড়া পাবেন। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পাবেন ৭০ হাজার টাকা করে। এছাড়া নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে বসবাস করলে সেটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে তিন মাসের বাড়ি ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা পাবেন তারা। চিফ হুইপ ও অন্য হুইপরাও এ সুবিধা নিতে পারেন।
নিজ এলাকার মসজিদ, মন্দির উন্নয়নসহ এলাকার মানুষের দাতব্য কাজে একজন মন্ত্রীকে বছরে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ খাতে প্রতিমন্ত্রী পাবেন সাড়ে ৭ লাখ ও উপমন্ত্রী পাবেন ৫ লাখ টাকা করে। এ টাকার মধ্যে মন্ত্রী চাইলে একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা দিতে পারেন। প্রতিমন্ত্রী দিতে পারেন ৩৫ হাজার, আর উপমন্ত্রী ২৫ হাজার টাকা। এলাকার উন্নয়নে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের এই টাকার কোনও নিরীক্ষা হয় না। ফলে এ টাকা খরচে অনেকটা উদার থাকেন তারা।
মন্ত্রী হওয়ার পর তার দফতরে দেশি-বিদেশি অনেকে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসেন। নির্বাচনি এলাকার মানুষও দেখা করতে আসেন। তাদের আপ্যায়নের জন্য একজন মন্ত্রী মাসে ১০ হাজার টাকা করে পান। এ খাতে প্রতিমন্ত্রী সাড়ে ৭ হাজার টাকা আর উপমন্ত্রী ৫ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। বিমান ভ্রমণের ক্ষেত্রে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বছরে বিমা সুবিধা পাবেন ১০ লাখ টাকা।
মন্ত্রিসভার সদস্যরা অসুস্থ হলে তার পুরো চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করে। এ ক্ষেত্রে বলা আছে, চিকিৎসা খরচ সীমাহীন। সরকার তার পুরো চিকিৎসার খরচ দেবে। তবে খরচের ভাউচার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিতে হবে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সরকারি খরচে একটি করে গাড়ি সুবিধা পাবেন। এই গাড়ি পরিবহন পুল সরবরাহ করে। তবে চিফ হুইপ ও হুইপদের গাড়ি সরবরাহ করে সংসদ সচিবালয়। এছাড়া সরকারি প্রয়োজনে ভ্রমণের সময় তারা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেকোনও সংস্থা বা দফতর থেকে একটি জিপ গাড়ি পাবেন। জ্বালানি বাবদ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ অর্থ পাবেন।
একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দেশের ভেতরে কোথাও ভ্রমণে গেলে দৈনিক ভাতা পাবেন দুই হাজার টাকা করে। ফলে চিফ হুইপও এই সুবিধা পাবেন।
সরকারি বাড়ি সাজসজ্জা করতে একজন মন্ত্রী প্রতিবছর পাবেন পাঁচ লাখ টাকা। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা পাবেন চার লাখ টাকা করে। এছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বাসভবনে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন ব্যয় যা আসবে, সরকার পুরোটাই বহন করবে।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী উপসচিব পদমর্যাদার একজন একান্ত সচিব (পিএস) পাবেন। এর বাইরে একজন সহকারী একান্ত সচিব এবং সরকারি কর্মকর্তার বাইরে নিজের পছন্দের একজন সহকারী, একান্ত সচিব পেয়ে থাকেন। এছাড়া দুই জন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, একজন জমাদার, একজন আরদালি, দুই জন অফিস সহায়ক ও একজন পাচক পেয়ে থাকেন। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী একজন একান্ত সচিব, একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন জমাদার, একজন আরদালি ও একজন অফিস সহায়ক পেয়ে থাকেন। এছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা একটি করে মুঠোফোন পাবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, পার্লামেন্ট পলিটিক্সে হুইপিং একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। চিফ হুইপসহ হুইপরা সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেন। হাউজের শৃঙ্খলা রক্ষাসহ সংসদ সদস্যদের সংসদমুখী করার ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া চিফ হুইপ বিশেষ কিছু দায়িত্ব পালন করেন। তার মধ্যে সংসদ নেতা, বিরোধী দল ও স্পিকারের সঙ্গে সমন্বয় করেন। সংসদ নেতার বার্তা স্পিকারকে অবহিত করেন। এছাড়া তিনি এমপিদের আবাসনসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন।
সাধারণত সংসদ নেতার পেছনের আসনে চিফ হুইপ বসেন। আর বিরোধীদলীয় নেতার পেছনে বসেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ।
আইন অনুযায়ী বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বা হুইপের কোনও অবস্থান নেই। নেই কোনও পদমর্যাদা বা সুযোগ-সুবিধাও। তবে সংসদের কার্যক্রমের স্বার্থে স্পিকার তাকে স্বীকৃতি দেন।