জেলা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর
লক্ষ্মীপুরে মাদকাসক্তদের হাতে চার মাসে সাতটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বসতঘরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দুই সন্তানসহ স্ত্রী ও কুপিয়ে স্ত্রী-শ্বশুরকে হত্যার ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনায় আতঙ্ক রাড়ছে।
সবশেষ ১৫ জানুয়ারি রাতে সদরের গঙ্গাপুর গ্রামে গাঁজা সেবনের টাকা না পেয়ে মাকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের নাম কিরন বেগম। এ ঘটনায় রাতেই ছেলে কাউছারকে আটক করে পুলিশ।নিহতের স্বজনরা জানিয়েছের, কাউছার মাদকসেবী। তাকে একাধিকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রেও রাখা হয়। মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে নির্মমভাবে তিনি কুপিয়ে হত্যা করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদরের গঙ্গাপুর গ্রামে ছেলের হাতে মা, গতবছরের ২৮ ডিসেম্বর সদরের উত্তর টুমচর গ্রামে ভাইয়ের হাতে ভাই, ১৩ সেপ্টেম্বর রামগতির চরকলা কোপা গ্রামে স্বামীর হাতে স্ত্রী ও শ্বশুর, ২৮ অক্টোবর সদরের বশিকপুর গ্রামে ঘরে পেট্রোল ঢেলে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীকে হত্যা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গতবছরের ২৮ ডিসেম্বর সদর উপজেলার উত্তর টুমচর গ্রামে রডের আঘাতে জাহাঙ্গীর আলম নামের একজনের মৃত্যু হয়। হামলাকারী ছোট ভাই মাহফুজ আলম মাদকাসক্ত ছিলেন। মামলার পর মাহফুজ আলমকে গ্রেফতার করে র্যাব। ১৩ সেপ্টেম্বর রামগতির চরকলা কোপা গ্রামে স্ত্রী-শ্বশুরকে কুপিয়ে হত্যা ও শাশুড়িকে রক্তাক্ত করেন জামাতা জাকির হোসেন সুমন। মাদক সেবন করায় স্ত্রী তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। এর জের ধরে ক্ষুদ্ধ জাকির ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান। নিহতরা হলেন রাশেদা আক্তার ও শ্বশুর বাদশা মিয়া।
২৮ অক্টোবর রাতে সদরের বশিকপুর গ্রামের কামাল হোসেন ঘরের ভেতর পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ভেতরে ছেলে আবদুর রহমান, মেয়ে আয়েশা আক্তার ও স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার মুন্নি ঘুমিয়ে ছিলেন। এতে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মেয়ে, ঢাকা মেডিকেলে ছেলে ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্ত্রী মারা যান। গ্রেফতার কামাল পেশায় অটোরিকশাচালক।
বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, কামাল মাদকাসক্ত। তিনি পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ তিনজনকে হত্যা করেছেন। গ্রেফতারের পর কামাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
রামগঞ্জ ও চন্দ্রগঞ্জ থানা সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। আগে উপজেলা শহরের উপকণ্ঠে এসব ধরা পড়তো। এখন নিয়মিত অভিযানে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও ইয়াবা, গাঁজা, মদসহ মাদক ব্যবসায়ী ও আসক্তরা গ্রেফতার হচ্ছেন। অনেকে জামিনে বেরিয়ে আবারও পুরোনো জগতে জড়িয়ে পড়েন। এদের একেকজনের বিরুদ্ধে ২-৭টি মাদক মামলা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভবানীগঞ্জ ও কেরোয়া ইউনিয়ন পরিষদের দুজন মেম্বার জানান, রাজনৈতিক মদদে গ্রামেও এখন ইয়াবা, গাঁজাসহ মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। মোবাইলফোনে বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে চলার পথে মাদক হাতবদল হয়। প্রতিবাদ করতে গেলেই বিপদ নেমে আসে।
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য রাসেল মাহমুদ ভূঁইয়া মান্না বলেন, মাদকের কারণে চার মাসে সাতটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুবই উদ্বেগের। এর ব্যবহারের বিষয়টি প্রতিমাসের সভায় উপস্থাপন করা হয়। পুলিশের কিছু তৎপরতা থাকলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর শুধু নিয়মরক্ষা অভিযান পরিচালনা করে।
লক্ষ্মীপুর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল আলম বলেন, জনসচেনতা সৃষ্টিসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন বলেন, মাদকসেবীদের জ্ঞান-স্মৃতি শক্তি কাজ করে না। এজন্য তারা আপনজনকে খুন করতেও বিন্দুমাত্র ভাবেন না। মূলত কিছু অসাধু পুলিশের কারণে মাদকরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, মাদকরোধে আইনের শাসন আর রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার প্রয়োজন। মাদক ব্যবসায়ীরা রাতারাতি কোটিপতি হন। এ লোভ অন্যদেরও টানে।
তিনি আরও বলেন, মামলার দুর্বলতার কারণেই আসামিরা জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক ব্যবসা শুরু করেন। এজন্য পারিবারিক-সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি নৈতিকতা, মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদকে ফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা পুলিশের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বলেন, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই গ্রেফতার হয়েছেন। আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। মাদক উদ্ধার ও বিক্রেতাদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চলছে।