ডেস্ক রিপোর্ট :
মিয়ানমারে স্বাধীনতার পর থেকেই চলছে অভ্যন্তরীণ সংঘাত। কিন্তু এবার যেন তা আর সামাল দিতে পারছে না দেশটির শাসকগোষ্ঠী। মিয়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে নিয়ন্ত্রণ হারানো বা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়ার বিষয় প্রায়ই উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান দেশটির গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনাকে আরও কমিয়ে দেয় বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব পরিণত হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধে। ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনী জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে গণতান্ত্রিক দল ও বিভিন্ন জাতিগত সংগঠন। মিয়ানমারের মতো ছোট একটি দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কীভাবে এত বড় আকার ধারণ করল? এই দ্বন্দ্বের শুরুই ঠিক কবে থেকে?
মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাস
ব্রিটেনের অধীন থাকা মিয়ানমার তৎকালীন বার্মা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছু বছর দেশটি জাপানের অধীন ছিল। দেশটির ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন জাতিগত সংঘাতের ছাপ আছে। কখনো সংঘাতের মাত্রা মৃদু, কখনো আবার তীব্র। ধরতে গেলে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ।
স্বাধীনতার প্রথম ১৪ বছর দেশটিতে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকলেও ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ছিল দমনমূলক একদলীয় সরকারব্যবস্থা। জেনারেল নি উইন এর নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৮ সালে উইনের বিরুদ্ধে জনগণ দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করলে তিনি পদত্যাগ করেন, কিন্তু এখানেই দেশটিতে সামরিক শাসনের ইতি ঘটেনি।
নি উইনের পর গণতন্ত্রের সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে মিয়ানমারের রাজনীতিতে আবির্ভাব হয় দেশটির জাতির পিতা অং সানের মেয়ে অং সান সু চির। ১৯৯০ সালে একাধিক দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনে অং সান সু চির জাতীয় গণতান্ত্রিক দল বা এনএলডি জয়লাভ করলেও সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আরও দুই দশক ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখেন। অবশ্য নির্বাচনের আগেই ১৯৮৯ সালে সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৯৫ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
পাঁচ বছরের ব্যবধানে আবার ২০০০ সালে সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়। দু-বছর পর তাকে মুক্ত করা হয়। কিন্তু এভাবে আবার পরের বছর তাকে গৃহবন্দি করা হয়। মেয়াদ বাড়াতে বাড়াতে অবশেষে ২০১০ সালে তাকে মুক্ত করা হয়। তিন দফায় প্রায় ১৫ বছর অং সান সু চি গৃহবন্দি ছিলেন। গণতন্ত্রপন্থি অং সান সু চিকে যেন ক্ষমতায় টিকতেই দেয়নি সেনাবাহিনী। তবে পরোক্ষভাবে সুচির কারণেই দেশটিতে আবার সামরিক শাসনের সূচনা হয়। কিন্তু কীভাবে?
মিয়ানমারের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব
২০০০ সাল থেকে জনগণের ক্ষোভ আর আন্তর্জাতিক মহলের চাপে মিয়ানমার ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের দিকে আসতে শুরু করে, আর দেশটিতে কিছুটা কমতে শুরু করে সামরিক শাসনের প্রভাব। কিন্তু ২০১০ সালে অং সান সু চির দল নির্বাচন বর্জন করলে দেশটিতে নামমাত্র বেসামরিক কিন্তু সামরিক সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় চলে আসে।
২০১৫ সালে দেশটিতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সু চির জাতীয় গণতান্ত্রিক দল অংশ নেয় এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। সুচি দেশটির কার্যত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীর প্রভাব বজায় ছিল; নিরাপত্তা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নীতির ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ ছিল। ২০২০ সালের নির্বাচনেও সুচি একইভাবে জয়লাভ করেন। কিন্তু ২০২১ সালে সেনাবাহিনী সরকারকে উৎখাত করে দেয় এবং নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করে। সেই সঙ্গে অং সান সুচি, প্রেসিডেন্টসহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।
এ ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচিত হয়। মিয়ানমারেও জনগণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ওপর হামলা চালায় দেশটির সরকার। এর কিছুদিন পরই মিয়ানমারে একটি নতুন সরকার গঠন করা হয়, নাম দেয়া হয় জাতীয় ঐক্য সরকার। এই সরকার মূলত ক্ষমতাচ্যুত আইনপ্রণেতা, সুশীল সমাজের কর্মী এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয়। আর সামরিক শাসকরা এই সরকারকে অবৈধ এবং সন্ত্রাসীগোষ্ঠী বলে দাবি করে।
গেল মে মাসে সামরিক বাহিনীকে প্রতিহত করতে ও আত্মরক্ষার জন্য জাতীয় ঐক্য সরকার একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে, নাম দেয় পিপলস ডিফেন্স ফোর্স। ঘটনাক্রমে সামরিক বাহিনী ও জাতীয় ঐক্য সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ ছাড়াও বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন, যারা কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে তাদের দ্বন্দ্বও চলমান ছিল।
অবশেষে ২০২১ সালে জাতীয় ঐক্য সরকার সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সাধারণ জনগণকেও যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যুদ্ধের কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ে মিয়ানমারের প্রতিটি প্রান্তে। এতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যাওয়ার পাশাপাশি লাখো মানুষ দেশের ভেতরে ও বাইরে বাস্তুচ্যুত হয়। তবে যুদ্ধের পর দেশের অনেক জায়গার কর্তৃত্ব হারিয়েছে সামরিক বাহিনী। অর্থাৎ পিপলস ডিসেন্স ফোর্স আর সামরিক বাহিনী এগোচ্ছে সমানে সমান।
যুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর অমানবিক কর্মকাণ্ড মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীরা বিমান হামলা থেকে শুরু করে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে হামলা, আটক যোদ্ধাদের হত্যা এবং বেসামরিক বাড়ি এবং ভবন পুড়িয়ে ফেলার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি
সম্প্রতি বিদ্রোহী কয়েকটি গোষ্ঠী এক হয়ে কয়েক দিনের মধ্যে, কয়েক ডজন সামরিক ফাঁড়ি এবং সেনাঘাঁটি দখল করেছে। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্টগুলোরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পয়েন্ট কিনসুহোর শহর দখল করেছে। তারা ‘১০২৭’ নামের একটি অভিযানও পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি মিয়ানমারে ভবিষ্যতেও ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
জাতীয় ঐক্য সরকার, পিপল ডিফেন্স ফোর্স ছাড়াও বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র জোট সামরিক শাসনবিরোধী কার্যক্রম জোরদারে তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয় সামরিক শাসনবিরোধী বেসামরিক জোটগুলোর ‘অপারেশন ১০২৭’-এর গতি ভবিষ্যতে বাড়বে নাকি দেশটিতে সামরিক শাসন চলতেই থাকবে। তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা শুধু শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক পরিবেশে জীবনযাপন।