শুধু সরবরাহকারী বা খুচরা বিক্রেতা নয়, মাদক মামলার তদন্তে ‘রুট’ বা উৎস খুঁজে বের করার নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি। রাজধানী ঢাকায় গড়ে প্রতিমাসে মাদক সংক্রান্ত মামলা রুজু হয় দেড় হাজার। কিন্তু বেশিরভাগ মামলার তদন্তেই মাদকের উৎস খুঁজে বের করা হয় না। শুধু সরবরাহকারী বা খুচরা বিক্রেতাকে অভিযুক্ত করেই মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করা হয়। এ কারণে মাদকের সরবরাহ কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। একজন সরবরাহকারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে মাদক ব্যবসায়ীরা অর্থের বিনিময়ে আরেকজন সরবরাহকারী নিয়োগ করে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সম্প্রতি মাদক মামলার তদন্তে রুট পর্যন্ত যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। ‘কোয়ালিটি ইনভেস্টিগেশন’ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার পাশাপাশি কোন আইনে কাকে অভিযুক্ত করতে হবে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে কমিশনারের নির্দেশনায়।
যোগাযোগ করা হলে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা মাদক ব্যবসা করে, ওর কাছে টাকা দিয়ে ক্যারিয়ার জোগাড় করা কোনও বিষয় না। আমি আজকে একজন ক্যারিয়ারকে ধরলাম, কাল সে আরও বেশি টাকা দিয়ে আরেকজন ক্যারিয়ার ঠিক করলো। আসলে মাদকে যে ব্যক্তি বিনিয়োগ করছে তার কাছে পৌঁছাতে না পারলে শুধু ক্যারিয়ার বা বহনকারী ধরে কোনও লাভ হবে না। সেজন্যই আমরা যতদূর যেতে পারি সেটা এনসিওর করতে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছি।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এখন একটা মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সিনিয়র অফিসার ইনভলভ হচ্ছেন, আমার ডিবির অফিসার ইনভলভ হচ্ছেন। ইনভলভ হয়ে মাদক মামলার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। সে কোথায় মাদক পৌঁছে দিতে চেয়েছিল এবং কার কাছ থেকে মাদক এনেছে, রাস্তায় কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, সবগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আমরা যেকোনও মূল্যে মাদক সরবরাহ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্রাইম জোন ও গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতদিন মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বেশিরভাগ সময় ক্যারিয়ার বা সরবরাহকারীদের ধরা হতো। এরপর মামলা হলেও ওই মাদক মামলায় মূল বিনিয়োগকারী বা মাদকের উৎসমূলে যাওয়ার প্রবণতা ছিল অনেক কম। মাদকের সঙ্গে গ্রেফতার ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হতো। মাদক মামলা নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের নতুন নির্দেশনার পর তদন্তে মাদকের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনারের এই নির্দেশনা ঘেঁটে দেখা গেছে, এখন থেকে মাদক মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ক্রিমিনাল ফোনবুক তৈরি করতে হবে। এজন্য ডিএমপি থেকে একটি নির্দিষ্ট ছক তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ফোনবুকে মাদক ব্যবসায়ীর সম্পর্কে চিত্র বা লিংক চার্ট ও মাদক প্রবাহচিত্র বা ফ্লো চার্ট তৈরি করে মাদক উদ্ধার সংক্রান্ত ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ বের করতে হবে। মাদক মামলার তদন্তে মাদক ব্যবসায়ীর অন্তত তিন মাসের সিডিআর বা কল ডিটেইলস রেকর্ড পর্যালোচনা করতে হবে। আসামিদের মোবাইল ফাইন্যান্সিং সার্ভিস অর্থাৎ বিকাশ, রকেট ও নগদ ইত্যাদির নম্বর ও লেনদেন বিবরণী সংগ্রহ করে অর্থ প্রবাহ চিত্র বা মানি ফ্লো চার্ট তৈরি কতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ মাদক মামলার ক্ষেত্রে অর্থ-লগ্নিকারীদের পরিচয় বের করে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক মামলা করতে হবে।
ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মাদক মামলায় গ্রেফতার আসামিদের জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা সিডিএমএস, এসআইভিএস বা ফিঙ্গারপ্রিণ্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে পরিচয় শনাক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে সব তথ্য সিডিএমএস-এ সংযোজন করে ও ছবিসহ পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল তৈরি করতে হবে। এছাড়া সাক্ষীদের নাম-ঠিকানার সঙ্গে মোবাইল নাম্বার ও পুলিশ সাক্ষীদের ক্ষেত্রে বিপি নম্বর সংযুক্ত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জোনাল সহকারী কমিশনার বা গোয়েন্দা পুলিশের টিম লিডাররা ‘দায়সারা ও গৎবাঁধা তদন্ত তদারকি নোট প্রদান করেন’ উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়, জোনের এসিদের ক্ষেত্রে আওতাধীন প্রত্যেকটি থানায় দায়ের হওয়া মাদক মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। ক্রাইম জোনের এসি বা ডিবির টিম লিডারদের তদন্তাধীন মাদক মামলায় মাদক ব্যবসায়ীর সম্পর্কে চিত্র, মাদকের প্রবাহ চিত্র ও অর্থ প্রবাহের চিত্র তৈরি করা নিশ্চিত করবেন।
ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনায়, মাদক উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে ক্রেতা পর্যন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্রে কাকে মানি লন্ডারিং ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের কোন ধারায় অভিযুক্ত করতে হবে তাও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মাদকের অর্থ প্রবাহ শুরু হয় মাদকাসক্ত ক্রেতার কাছ থেকে। ক্রেতার কাছ থেকে অর্থ যায় খুচরা বিক্রেতার কাছে। খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে অর্থ যায় পাইকারী মাদক বিক্রেতার কাছে। পাইকারী বিক্রেতা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে অর্থ পাঠায় ডিলার ও বাহকের কাছে। বাহকের মাধ্যমে অর্থ যায় গাড়ির মালিক ও চালকের কাছে। ডিলার হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে অর্থ পাঠায় মাদক প্রস্তুতকারী বা কারখানার মালিকদের কাছে। একই সঙ্গে সীমান্ত এলাকার সহযোগীদের কাছে টাকা পাঠায় ডিলার। মামলার তদন্তে প্রত্যেককে শনাক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মাদক মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা মাদক নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ, লিংক চার্ট খুঁজে বের করা মানে মাদকসহ যাকে গ্রেফতার করা হবে, সে কার কাছে মাদকগুলো পৌঁছে দিতো এবং কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে, এই দুই দিকেই অনুসন্ধানন শুরু করলে কারখানা থেকে ক্রেতা পর্যন্ত প্রত্যেককেই শনাক্ত করা যাবে। কিন্তু আগে তদন্তের ক্ষেত্রে শুধু যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকেই অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হতো। এ কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল হোতা বা ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতো।
ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যেকোনও মূল্যে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে বদ্ধপরিকর। এ কারণে তদন্তে নতুন ডাইমেনশন আনার চেষ্ট করছি। গভীরতর তদন্ত করলে একটা সফলতা আসবেই। আমরা যদি মাঠপর্যায় থেকে রুট পর্যন্ত লোকজনকে শনাক্ত করতে পারি, তাহলে তো অন্তত তাদের চেইনটা নষ্ট করা যাবে। আমরা মাদক ব্যবসার চেইনগুলো নষ্ট করে দিতে চাই