রংপুর প্রতিনিধিঃ
নয়নাভিরাম সবুজ প্রকৃতি। চারদিকে সারি সারি গাছগাছালি। সঙ্গে মিশে আছে মেঠোপথ। পাখির চোখে রং-তুলিতে আঁকা রূপসি বাংলা। পিচঢালা সড়কের পাশের আঁকাবাঁকা সরু মেঠোপথে হাঁটতেই নজর কাড়বে একটি মসজিদ। যেন দিগন্ত জোড়া ফসলি খেতের মাঝে মসজিদটি ভাসমান।
এটি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ২১৩ বছর আগে নির্মিত মসজিদটি বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম এক নিদর্শন। রংপুর মহানগরী থেকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিঠাপুকুর উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে এশিয়ান হাইওয়ের উত্তর-পশ্চিম পাশে মসজিদটির অবস্থান।
এই মসজিদটি মিঠাপুকুর মসজিদ বা মিঠাপুকুর বড় মসজিদ নামে পরিচিত। ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই উপজেলায় ৮৬০টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে দর্শনার্থীদের কাছে বেশ সমাদৃত এই মসজিদ।
মসজিদের প্রবেশদ্বারে সাঁটানো তথ্য থেকে জানা যায়, প্রাচীন মসজিদটি হিজরি ১২২৬ মোতাবেক ১২১৭ বঙ্গাব্দ শুক্রবার এবং ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে জনৈক শেখ মোহাম্মদ মোয়াজ্জম এর প্র-পুত্র শেখ মুহাম্মদ আসীন পিতা শেখ মোহাম্মদ সাবের কর্তৃক এটি নির্মিত হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি নির্মিত হয় মোঘল আমলের শেষ দিকে। মসজিদ থেকে একটু দূরে একটি জলাশয় রয়েছে। এটি যে প্রাক মুসলিম আমলে তৈরি তাতে সন্দেহ নেই। এ জলাশয় বা দিঘির নামানুসারে স্থানের নামকরণ হয়েছে মিঠাপুকুর।
মসজিদটির আয়তাকার পরিমাপ আনুমানিক ১০.৬৬ মি. এবং তিনটি গোলাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। মসজিদের চারপাশে রয়েছে সুরম্য গেটসহ অনেক পুরোনো বাউন্ডারি দেয়াল। দেয়ালের অভ্যন্তরে রয়েছে খোলা আঙিনা। মসজিদের চার কোনায় পিলারের ওপর রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো আট কোনাকারে নির্মিত। মিনারগুলো ছাদের কিছু ওপরে ওঠে গম্বুজ আকৃতিতে শেষ হয়েছে।
মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে কারুকার্য খচিত তিনটি প্রবেশদ্বার। মসজিদের মাঝের প্রবেশদ্বারের দুই পাশের পিলারের ওপরও রয়েছে ছোট দুটি মিনার। সামনের অংশে পোড়া মাটির কারুকার্য মসজিদটিকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। মসজিদের ভেতরে সামনের দরজা বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মেহরাব।
চারপাশের কৃষিজমি বেষ্টিত মসজিদটি অনন্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। মসজিদটির প্রবেশদ্বারেও রয়েছে কারুকাজের ছাপ। মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো কন্দকারে নির্মিত সুবিশাল তিনটি গম্বুজ। গোলাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত মসজিদটির প্রথম প্রবেশদ্বার বাংলাদেশি স্থানীয় সংস্কৃতির আদলে তৈরি।
এ ছাড়া চার কোণের উঁচু ছাদ। এখানে তিনটি অংশে মসজিদ ভাগ করে ৩ সেমি বৃত্তাকার গম্বুজ ও প্যারা-পুলি দেওয়াল নির্মিত হয়। গম্বুজগুলো সুন্দর প্যানেল, লতাপাতা, ফুল, জ্যামিতিক আকারের সঙ্গে পরিকল্পিত। দেখতে ড্রামস এবং দেয়ালের সাপের শিলালিপির মতো। মূল দরজা দিয়ে ঢুকে সুন্দর একটি উঠান বা বারান্দা। ফ্যাকাশে লালচে ইট রঙে গড়া মসজিদটি যে কারোই ভালো লাগবে।
এখানে আসতে হলে প্রথমে বাস বা অটোরিকশায় করে মিঠাপুকুর গড়েরমাথা নামক জায়গায় আসতে হবে। এরপর সেখান থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে এশিয়ান হাইওয়ে। বিরামপুর ও দিনাজপুর মহাসড়ক ধরে হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট আর রিকশায় গেলে দুই মিনিটেই যেতে পারবেন মিঠাপুকুর বড় মসজিদে। রাস্তা থেকেই বাম দিকে বা দক্ষিণ দিকে তাকালেই চোখে পড়বে মেঠোপথ বেয়ে সবুজের বুকে ভাসমান এই সুন্দর মসজিদটি।
ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটিতে নামাজ পড়তে আসা রিপুল মিয়া নামের এক মুসল্লি বলেন, মসজিদের ভেতরে ও বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ রয়েছে, যা দেখতে অনেক ভালো লাগে। মসজিদের এসব কারুকাজ দেখলে আগের যুগের রাজা-বাদশাহদের কথা মনে যায়। প্রাচীন এই মসজিদে নামাজ আদায় করে মনে প্রশান্তি খুঁজে পান বলেও জানান তিনি।
আখতারুজ্জামান নামের আরেক মুসল্লি বলেন, মসজিদের ভেতরে এক লাইন কাতার রয়েছে। এর বাইরে বারান্দাতেও নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মুসল্লিদের মসজিদে জায়গা সংকুলান হয় না। আবার বর্ষাকালে বাইরে নামাজ পড়তে গেলে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। আর রোদের দিনে প্রচণ্ড রোদে নামাজ পড়তে কষ্ট হয়। ২০০ বছরের প্রাচীন এই মসজিদটি প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হওয়ায় কমিটির লোকজনও মসজিদটিকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে পারছে না। আবার সরকার থেকেও মসজিদটি সংস্কারে তেমন উদ্যোগ আমরা খেয়াল করছি না।
নীলফামারী থেকে মসজিদটি দেখতে আসা শরিফুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, রংপুরে অনেক প্রাচীন ঐহিত্য রয়েছে। এর মধ্যে মিঠাপুকুর মসজিদটি অন্যতম। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নজনের কাছ থেকে মসজিদটির কথা শুনেছি। এবার এই মসজিদে প্রথমবার এসে আমার বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং প্রচার-প্রচারণা না থাকায় মসজিদটি পর্যটনকেন্দ্রিক হয়ে উঠেনি।
মসজিদটির ইমাম মোজাম্মেল হক বলেন, আমি এখানে দুই মাস ধরে নামাজ পড়াচ্ছি, আজানও দিই। আমাদের এই মসজিদটা অনেক পুরাতন। ভেতরে এক কাতারে ১৭ থেকে ১৮ জন নামাজ পড়তে পারে। প্রতি ওয়াক্তে ভেতর ও বাইরে মিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ জন নামাজ পড়ে এখানে। আর বারান্দায় পাঁচ কাতারে নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি আর রোদে নামাজ পড়তে কষ্ট হয় মুসল্লিদের।
প্রাচীন মসজিদটিতে কয়েক বছর ধরে সংস্কারের কাজ হয়নি বলে জানিয়েছেন মসজিদ কমিটির সভাপতি এমদাদুল হক। তিনি বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে সরকারি অর্থায়নে মসজিদটির মূল নকশা, আকার ও বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে কিছু সংস্কার করা হয়েছে। এ মসজিদটি কারও মতে ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে আবার কেউ কেউ বলছে এরও আগে এটি নির্মিত হয়েছে। তবে মসজিদে সাঁটানো তথ্য অনুযায়ী এটি ২১৩ বছরের পুরাতন স্থাপনা।
প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত এ দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি প্রাচীনকাল থেকে মিঠাপুকুরকে ইসলামী জনপদ হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। আর এই ঐতিহাসিক মসজিদকে ঘিরে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থী ও পর্যটকের আগমন ঘটছে।