নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
দলের স্থায়ী কমিটির দুই-তিনজন নেতার দূতিয়ালিতে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতার সখ্য গড়ে উঠছে এবং পুরোনো ‘সন্দেহ-অবিশ্বাস’ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটিকে আবারও কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি- কিছুদিন ধরে এমন একটি গুঞ্জন চলছে বিএনপির ঘরে-বাইরে। এ নিয়ে বিএনপির একাংশ এবং দলটির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলছেন, বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতার সম্পর্ক উন্নয়নের কারিগর দলের স্থায়ী কমিটির এক নেতা। তিনি ২০১৫ সাল থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে আছেন দেশে অবস্থান করা আরও দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্য, যারা বিভিন্ন সময় দলের শীর্ষ নেতাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন আন্দোলন-সংগ্রামে অন্যান্য দল ও জোটের চেয়ে জামায়াত বেশি কার্যকর। মূলত তারা জামায়াতের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে দলটিকে বিএনপির সঙ্গী করতে দূতিয়ালির কাজ করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি দেশের বাইরে আছি। এই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ঘরে আগুন লেগেছে, তা নেভাতে যে আসবে আমরা তাকে স্বাগত জানাব। এই সরকারের বিরুদ্ধে ডান-বাম যারা আন্দোলন করবে তাদের সবাইকে আমরা স্বাগত জানাই। আর জামায়াতের সঙ্গে তো আমাদের জোট হচ্ছে না। এখন যা হবে তা হলো যুগপৎ, আগামী দিনের আন্দোলন হবে যুগপৎ আন্দোলন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াত বিরোধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ঘরে আগুন লেগেছে, তা নেভাতে যে আসবে আমরা তাকে স্বাগত জানাব। এই সরকারের বিরুদ্ধে ডান-বাম যারা আন্দোলন করবে তাদের সবাইকে আমরা স্বাগত জানাই। আর জামায়াতের সঙ্গে তো আমাদের জোট হচ্ছে না। এখন যা হবে তা হলো যুগপৎ, আগামী দিনের আন্দোলন হবে যুগপৎ আন্দোলন।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে দলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। সেখানে স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে দলের শীর্ষ নেতাদের পরামর্শ দেন বিএনপির তৃণমূল নেতারা।ওই নির্বাচনের পর ২০২০ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠকে অধিকাংশ সদস্য জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার পক্ষে মত দেন। এরপর জামায়াতকে নিয়ে গঠিত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক শীতল ও এক প্রকার ছিন্ন হয়ে যায়। ২০২৩ সালে ২০ দলীয় জোটই ভেঙে দেয় বিএনপি। তখন জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকার বিষয়ে সন্দেহ করেন বিএনপি নেতারা। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, দলের মধ্যে যারা প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা করেন তারা সবাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে চলে যান। তখন দলের মধ্যে যারা জামায়াত ঘেঁষা তারা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বোঝান, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার যে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল সেটি পুরোপুরি ঠিক নয়। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জামায়াত সেটা প্রমাণ করেছে।
ফলে, সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে। সেটা কিছুটা প্রকাশ্যে আসে গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) রাজনীতিকদের সম্মানে বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে। সেখানে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে এক টেবিলে বসে ইফতার করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই ইফতারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (ভার্চুয়ালি)।
এরপর গতকাল ৩০ মার্চ আট বছর পর অনুষ্ঠিত জামায়াতের ইফতারেও মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা অংশগ্রহণ করেন।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে এখন জামায়াতকে কাছে টানা হচ্ছে। তবে এটা ধরে রাখেন জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চ আর হবে না। যেটা হবে, যুগপৎভাবে তারা নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করবে।
এই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সিপিবি-বাসদ, মেনন ও ইনুর দলের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিএনপির জোট ছেড়ে গিয়েছিলেন এরশাদও। আসলে ১৯৯১ সালে জামায়াত বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়ে ইমোশনালি অনেক কাছে চলে আসে। যার ফলে, নানা সময় বিএনপির সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা সত্ত্বেও জামায়াত প্রসঙ্গে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দলটি।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক হওয়ায় বামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সিপিবি-বাসদ, মেনন ও ইনুর দলের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিএনপির জোট ছেড়ে গিয়েছিলেন এরশাদও। আসলে ১৯৯১ সালে জামায়াত বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়ে ইমোশনালি অনেক কাছে চলে আসে। যার ফলে, নানা সময় বিএনপির সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা সত্ত্বেও জামায়াত প্রসঙ্গে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দলটি।
এ নেতা আরও বলেন, বিএনপির তৃণমূল সবসময় জামায়াত বিরোধী। দলের মধ্য সারির নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। কিন্তু দলের উচ্চ পর্যায়ের কিছু লোক জামায়াত থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন।গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, জামায়াত-বিএনপির নতুন ঘনিষ্ঠতাকে মঞ্চের একটি শরিক দল ছাড়া কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের এই ঘনিষ্ঠতার রাজনৈতিক চরিত্র কী হবে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সবাই মনে করে বিএনপি যদি জামায়াতকে নিয়ে সামনের দিনে পথ চলতে চায় তাহলে মঞ্চের কেউ তাদের সঙ্গে থাকবে না। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে মাহমুদুর রহমান মান্নার দল, তারা হয়ত বিএনপির সঙ্গে যেতে পারে। তারপরও আমরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মঞ্চের মিটিং করে বিষয়টি নিয়ে সবার, বিশেষ করে মান্না ও আ স ম রবের মতামত জানতে চাইব।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন করে বিএনপি-জামায়াত ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। এটা নিয়ে আমাদের দল কিংবা গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আশা করছি, আগামী দিনে রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে লিয়াজোঁ কমিটির মিটিং হবে। তখন এ নিয়ে আলোচনা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই রাজপথের বিরোধীদলগুলো আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকুক। সেখানে জামায়াত তাদের মতো করে আন্দোলন করতেই পারে।ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে এক মঞ্চ তৈরি করতে চাইলে আমরা থাকব না। তবে, আমাদের আন্দোলন চলবে।