সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের জন্য প্রস্তুত শোলাকিয়া, থাকছে বিশেষ দুটি ট্রেন
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
জেলা প্রতিনিধি,কিশোরগঞ্জঃ
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদুল ফিতরের দেশের সবচেয়ে বড় জামাত আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সাজানো হচ্ছে সব আয়োজন। এখন চলছে শেষমুহূর্তের প্রস্তুতি। মাঠে যেতে মুসল্লিদের জন্য থাকছে বিশেষ দুটি ট্রেন।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদ সূত্র জানায়, শোলাকিয়ায় এবার ১৯৭তম ঈদের জামাত হবে। নামাজ শুরু হবে সকাল ১০টায়। ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা মো. ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ইমামতি করবেন। নারীদের জন্য সূর্যবালা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আলাদা জামাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।সরেজমিনে ঈদগাহ মাঠ ঘুরে দেখা যায়, নামাজের জন্য মাঠে দাগ কাটা, বালু ফেলা, দেয়াল রঙ করার কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে অজুখানা ও শৌচাগার সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। এখন বিদ্যুতের লাইন টানা ও সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। একইসঙ্গে মাঠ ও শহরজুড়ে শোভাবর্ধনের কাজও চলছে।
ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় সাত একর আয়তনের ঈদগাহের মূল মাঠে নামাজে প্রায় ২৫০টি কাতার থাকবে। প্রতিটি কাতারে ৬০০-৭০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করার সুযোগ পাবেন। মূল মাঠের চারপাশে আরও অনেক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মাঠের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থাকবেন পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা। মাঠের ভেতর-বাইরে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাসহ ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে পুরো মাঠের মুসল্লিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে কয়েক লাখ মুসল্লি ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে শোলাকিয়ায় আসেন। লোকসমাগম এত বেশি হয় যে, ঈদগাহ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তা, সেতু, নদীর পাড়, আশপাশের পতিত জমি, বাসাবাড়ি, বাড়ির ছাদে লোকজনকে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়। তখন পুরো এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নেয়।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দূর-দূরান্তের মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য শোলাকিয়া স্পেশাল নামে দুটি ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ময়মনসিংহ ও ভৈরব থেকে দুটি বিশেষ ট্রেন কিশোরগঞ্জে আসবে। মুসল্লিদের অজু ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা, মেডিক্যাল টিম, নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সব আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।’ নিরাপত্তার স্বার্থে ঈদের জামাতে কেবল জায়নামাজ নিয়ে মাঠে প্রবেশের অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ছাতা, ব্যাগ, লাঠি কিংবা লাইটারজাতীয় কিছু নিয়ে মাঠে না আসায় ভালো। সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জামাত আয়োজনে সবার সহযোগিতা চাই আমরা।’
শোলাকিয়ার জামাত কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে ঈদের পাশাপাশি বাড়তি আনন্দের উপলক্ষ হয়ে ধরা দেয়। বড় জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করলে বেশি সওয়াব পাওয়া যায় এই বিশ্বাস থেকে লাখ লাখ মুসল্লি এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন। এবারও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। জামাতের প্রস্তুতি ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টরা বেশ কয়েকবার ঈদগাহ মাঠ পরিদর্শন করেছেন। আয়োজনে কোনও ত্রুটি রাখতে চান না তারা।২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার পর থেকে শোলাকিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত ও কঠোর করা হয়েছে বলে জানালেন জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ। তিনি বলেন, ‘এবার পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএনের পাশাপাশি মোতায়েন থাকবে বিজিবি। থাকবে ড্রোন ক্যামেরাসহ পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর ও পুলিশের চেকপোস্ট।’
জেলা প্রশাসন ও পুলিশ জানিয়েছে, নামাজের সময় প্রায় ১৪০০ পুলিশ, পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, শতাধিক র্যাব সদস্য ছাড়াও আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও আনসার সদস্যরা মাঠ ও মাঠের বাইরে মোতায়েন থাকবেন। সাদা পোশাকে নজরদারি করবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। থাকবে ফায়ার ব্রিগেড, তিনটি অ্যাম্বুলেন্স, মেডিক্যাল টিম ও পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম। ঢাকা থেকে আসবে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। পুরো মাঠ বেশ কয়েকবার মাইন ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হবে।
শোলাকিয়ায় যেতে বিশেষ ট্রেন- মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি বিশেষ ট্রেন চালু করবে। এর একটি ভৈরব থেকে, আরেকটি ময়মনসিংহ থেকে শোলাকিয়ার উদ্দেশে ছাড়বে। ভৈরব-কিশোরগঞ্জ (স্পেশাল) নামের ট্রেনটি ভৈরব স্টেশন থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে আসবে। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ (স্পেশাল) নামের অপর ট্রেনটি সকাল ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে ছাড়বে। নামাজ শেষে দুপুর ১২টায় এসব ট্রেন কিশোরগঞ্জ স্টেশন থেকে ফিরে যাবে। বাসে করেও ঈদগাহে পৌঁছে দিতে বিশেষ সার্ভিস চালু করছে বিভিন্ন বাস কোম্পানি।
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের যাত্রা শুরু যেভাবে- ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা জানিয়েছেন, শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮২৮ সাল থেকে। স্থানীয় সাহেববাড়ির সৈয়দ আহম্মদ (র.) তার নিজ সম্পত্তিতে প্রথমবারের মতো ঈদ জামাতের আয়োজন করেন। সেবার তিনি নিজেই ইমামতি করে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মাঠের প্রসার ও পরিচিতি ঘটান ঈশা খাঁর বংশধর স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের সদস্য দেওয়ান মান্নান দাদ খান।
মাঠের নামকরণ- শোলাকিয়ার আগের নাম ছিল রাজাবাড়ীয়া। জনশ্রুতি আছে, একসময় শোলাকিয়া ঈদগাহে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সোয়া লাখ মুসল্লি হওয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেই থেকে ঈদগাহটি একসময় শোয়ালাকিয়া ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নামকরণের এমন ধারণার সঙ্গে অনেক ইতিহাসবিদের দ্বিমত আছে। অন্য মতটি হলো, মুঘল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। কালের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া, বর্তমানে শোলাকিয়া যার নাম হয়েছে।
তাড়াইলের সাচাইল গ্রাম থেকে ঈদের জামাতের খোঁজখবর নিতে ছেলেকে নিয়ে শোলাকিয়া মাঠে এসেছেন আজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘প্রায় এক যুগ বছর ধরে শোলাকিয়ায় নিয়মিত নামাজ পড়ি। ২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার সময়ও মাঠে ছিলাম। তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। তবে এরপর থেকে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। তাই ওই ভয় এখন আর নেই। এবারও ঈদ জামাতে অংশ নেবো।’
ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য জানান, ঈদের আগের দিন থেকে দেশের বহু জেলা থেকে লোকজন শোলাকিয়ায় আসতে শুরু করেন। তাদের আবাসন ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে করা হয়।রেওয়াজ অনুযায়ী, বন্দুকের গুলি ফুটিয়ে ঈদ জামাত শুরুর সংকেত দেওয়া হয়। জামাত শুরুর ১৫ মিনিট আগে তিনটি, ১০ মিনিট আগে দুটি এবং পাঁচ মিনিট আগে একটি শটগানের গুলি ফোটানো হয়।