ঠাঁই নেই হাসপাতালে, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ফিরে যাচ্ছেন করোনা রোগীরা!

প্রকাশিত: ৪:২৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০২১

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। শয্যা সংকটে রোগী ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে হাসপাতাল। ফলে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যার জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। ঈদের পর থেকেই হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ সংকট দেখা দেয়। গত তিন দিনে তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ঢাকার বাইরের দুই শতাধিক রোগী রাজধানীতে আসছেন আইসিইউ-এর জন্য। সাধারণ শয্যার জন্য রোগী আসার সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। রোগীদের আইসিইউ-এর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন মাত্র দুই একটা বেড খালি হচ্ছে। কোনও রোগী সুস্থ হলে কিংবা মারা গেলেই কেবল শয্যা খালি হয়।

এমতাবস্থায় হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে রোগী নিয়ে ঘুরছেন স্বজনরা। করোনার থাবা থেকে বাঁচতে ঠাঁই মিলছে না হাসপাতালে।

বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অসংখ্য রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। শেষে ভর্তি হতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেছেন অনেক রোগী। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের সামনে ‘সিট খালি’ নেই জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি টানাতে বাধ্য হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সীমান্তবর্তী পশ্চিমের জেলাগুলোয় রোগীর চাপ কমলেও পূর্ব ও মধ্যভাগের জেলাগুলোয় করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। রোগীর চাপ সামলাতে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে প্রস্তুতকৃত ফিল্ড হাসপাতালটি আশা করছি রবিবারের মধ্যে চালু করতে পারব।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার বাইরে জেলাগুলোয় স্বাস্থ্য অধিদফতর আলাদা করে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করবে না। কারণ, এতে লজিস্টিক সহায়তা ও জনবল সহায়তা দেওয়া আমাদের জন্য দুরূহ হবে। তাই জেলাগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রোগীর চাপ বেড়ে গেলে প্রয়োজন অনুযায়ী স্থানীয় মেডিকেল কলেজ কিংবা ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফিল্ড হাসপাতালের ব্যবস্থা করার।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ২৭১ জন, মারা গেছেন ২৩৯ জন। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১২ লাখ ২৬ হাজার ২৫৩ জন, মারা গেছেন ২০ হাজার ২৫৫ জন। গতকাল করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৯ দশমিক ২১ শতাংশ। গতকাল ঢাকার ১৩টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ১১টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ১৩৯টি সাধারণ শয্যার মধ্যে তিনটি ফাঁকা ছিল। আইসিইউয়ের ২৬টি শয্যাতেই রোগী ভর্তি ছিল। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ২৭৫টি, সেখানে শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত ৬৩ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১০টি আইসিইউতেই রোগী ভর্তি ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০টি আইসিইউয়ের সবগুলোতেই রোগী ভর্তি। ৭০৫টি সাধারণ শয্যার বিপরীতে ৭১১ জন রোগী ভর্তি ছিল। হাসপাতালে শয্যা না থাকায় ফিরে যাচ্ছে রোগীরা।

গত ছয় দিন ধরে করোনা আক্রান্ত হয়ে খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন সাতক্ষীরার মোয়াজ্জেম আলী। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঢাকায় রেফার্ড করেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ঢাকা এসে বিপদ আরও বেড়েছে। সংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরলেও মিলছে না শয্যা। অবশেষে রাস্তাতেই মারা যান তিনি।

মোয়াজ্জেম আলীর ভাই সোয়েব আলী বলেন, ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল ঘুরে একটা আইসিইউ পাইনি। পরে ঢাকা মেডিকেলে এসেছিলাম। ভাইকে অ্যাম্বুলেন্সে রেখে হাসপাতালে সিট খুঁজতে গিয়েছিলাম। সিটও পেলাম না, ফিরে এসে ভাইকেও আর জীবিত পেলাম না। হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতেই মারা গেলেন তিনি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘রোগী যে হারে আসছে, সব রোগী আমরা ভর্তি নিতে পারছি না। কারণ, কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। আমাদের অক্সিজেন সংযোগসহ বেড রয়েছে ৭৫০টি। যে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছে তাদের অক্সিজেন সরবরাহ দেওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আমরা রোগী রিলিজ না হলে আর নতুন রোগী ভর্তি নিচ্ছি না। সাধারণ শয্যার পাশাপাশি আইসিইউয়ের জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর তালিকা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে।’

ঈদের ছুটি শেষ হতেই প্রতিদিনই রেকর্ড ছাড়াচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এরই মধ্যে বেডের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করেও চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। এতদিন আইসিইউ বেডের সংকট তীব্র ছিল। এখন সাধারণ বেড সংকটের কারণে রোগী ভর্তি বন্ধ করে দিচ্ছে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো বড় বড় হাসপাতালগুলো। রোগী নিয়ে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরেও একটা বেড পাচ্ছে না স্বজনরা, বাড়ছে মৃত্যু।

দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শয্যা সংকটের কারণে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না হাসপাতালটি। গত বুধবার থেকে অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তির জন্য গিয়ে ফিরে এসেছে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, ‘গত কয়েক দিন থেকে রোগীর চাপ বেড়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে নতুন রোগী ভর্তি করা কঠিন হয়ে গেছে। প্রতিদিন আমরা রিলিজ দিতে পারি ৩০-৪০ জন রোগী, কিন্তু ভর্তির জন্য আসছে শতাধিক রোগী। বেড খালি না থাকায় রোগীদের ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আমাদের হাসপাতালে ৩২০ করোনা রোগী ভর্তি আছেন। আমরা যদি এ মুহূর্তে আরও অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করি, তাহলে আমাদের হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাদের অনেকে ঠিকমতো অক্সিজেন পাবেন না। ফলে বাধ্য হয়ে এ মুহূর্তে নতুন করে রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে বলা হয়, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালের ৩ হাজার ৮৩৮টি সাধারণ শয্যার বিপরীতে শয্যা ফাঁকা ছিল ১ হাজার ৯৯টি। ৩৮১টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ফাঁকা ছিল ১৬টি। তবে এসব শয্যার সমপরিমাণে রোগী ভর্তি করতে পারছে না হাসপাতালগুলো। কারণ অনেক শয্যাতেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন কিংবা হাই ফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা আছে ২ হাজার ৩১টি, এর মধ্যে রোগী ভর্তি ছিল ৫০৫টিতে। বেসরকারি হাসপাতালেও আইসিইউ পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বেসরকারি হাসপাতালে ৫০৭টি শয্যার মধ্যে ৮১টি ফাঁকা ছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে।

ডিএনসিসি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালে রোগীর ভীষণ চাপ। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ৫৪৫ জন রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে ২০৪ জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছে, ৫৩ জন সাধারণ বেডে এবং বাকিরা এসডিইউতে ভর্তি আছে। প্রতিদিন হাসপাতালে অসংখ্য রোগী ভর্তির জন্য আসছে। গত বুধবার ১১১ জন রোগী রিপোর্ট করেছিল, তার মধ্যে ৬০ জন রোগী আমরা ভর্তি করেছি। সংকটাপন্ন রোগী সবচেয়ে বেশি আসছে। দুপুর পার হতেই আইসিইউ বেড শেষ। এরপরে রোগী ভর্তির সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ৫০০ বেড সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় এবং বাকি ৫০০ সিলিন্ডার অক্সিজেনে চলছে। কম সংকটাপন্ন এমন রোগীদের এসব সিলিন্ডার অক্সিজেন সাপোর্ট বেডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

টানা পাঁচ দিন দুই শতাধিক মৃত্যু : করোনাভাইরাস সংক্রমণে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ২৩৯ জন। এ নিয়ে ঈদের পর টানা পাঁচ দিন দুই শতাধিক মৃত্যু দেখল দেশ। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজার ২৭১ জনের দেহে। এদিকে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা শনাক্ত রোগীর চেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে করোনার উপসর্গ নিয়ে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫২ হাজার ২৮২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫ হাজার ২৭১ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৯.২১ শতাংশ। এ নিয়ে গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১২ লাখ ২৬ হাজার ২৫৩ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২০ হাজার ২৫৫ জনের। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১০ লাখ ৫০ হাজার ২২০ জন।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা শনাক্ত রোগীর চেয়ে উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে বেশি। মৃত্যুর আগে নমুনা দেওয়া না হলে মৃত্যুর পর আর পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে জানা যাচ্ছে না এসব রোগীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। গত ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা যান ১৬ জন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ ছিলেন ৩ জন। বাকি ১৩ জন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে বুধবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২ জন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। বাকি ৫ জন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। বগুড়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩ জন এবং উপসর্গ নিয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জন করোনা পজিটিভ ছিলেন, অন্যরা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণে মারা যাওয়া ২৩৯ জনের মধ্যে ১২৩ জন ছিলেন পুরুষ ও ১১৬ জন নারী। ২২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ও ১৫ জন বাড়িতে মারা গেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এ ছাড়া ৫৭ জন চট্টগ্রাম, ১৩ জন রাজশাহী, ৪৫ জন খুলনা, ১৪ জন বরিশাল, ১৪ জন সিলেট, ১১ জন রংপুর ও ৯ জন ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছেন। বয়স বিবেচনায় মৃতদের মধ্যে ১২৩ জন ছিলেন ষাটোর্ধ্ব, ৫৭ জন পঞ্চাশোর্ধ্ব, ২৬ জন চল্লিশোর্ধ্ব, ১৫ জন ত্রিশোর্ধ্ব, ১৪ জন বিশোর্ধ্ব, ৩ জনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ও ১ জনের বয়স ছিল ১১ বছরের কম।