ইমরান হুসেইন, মুন্সি তারা মিয়া, হাবীব হাসান, মোল্লা সোহাগ আশায় বুক বেঁধেছিলেন, সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাবেন স্বপ্নের ইউরোপে। উন্নত জীবনমান আর বেশি আয়ের স্বপ্নে প্রলুব্ধ হয়ে মানবপাচারকারীর হাত ধরে শুরু হয় তাদের ভূমধ্যসাগরের মরণযাত্রা। পরে মাঝ সমুদ্রে তাদের উদ্ধার করে আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্ধারকারী জাহাজ। আশ্রয় হয় ইউরোপীয় অঞ্চলের একটি দ্বীপ মাল্টায়। কথা বার্তা অসংলগ্ন হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পরিচয় নিশ্চিত করে রেখে দিয়েছেন ডিটেনশন সেন্টার নামক এক প্রকার জেলে। আর তাদের সেখান থেকে মুক্ত করে সে দেশে বৈধ উপায়ে কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-আয়েবা।
মাল্টা থেকে কিছু দিন পরপরই বন্দি কিংবা আটক বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মাল্টা সরকারের এমন পদক্ষেপ। সেখান থেকে গত জুন মাসেও ১৫৮ এবং তারও আগে ৪৪ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। তাদের দেশে ফেরার জন্য আউটপাস ইস্যু করে গ্রিসের এথেন্সে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। কারণ, মাল্টায় বাংলাদেশের কোনও দূতাবাস নেই। মাল্টা সরকারের চলমান ফেরত পাঠানোর কার্যক্রমে রীতিমতো আতঙ্কিত সেখানে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে পার করতে হচ্ছে দিন-রাত।
তবে বন্দি এসব বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত না পাঠিয়ে সেখানে কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-আয়েবার নেতারা। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মাল্টায় প্রবেশ করায় ১৬৫ বাংলাদেশি দীর্ঘ ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে বন্দি আছে ডিটেনশন সেন্টারে। তাদের মুক্ত করতে মাল্টা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আয়েবার নেতারা।
সংগঠনের মহাসচিব কাজী এনায়েত উল্লাহর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মাল্টা যান। দেশটির স্বরাষ্ট্র সচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। মাল্টা সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকে অংশ নেন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব কেভিন মাহোনে, নিরাপত্তা এবং আইন প্রয়োগ সংস্থার কর্মকর্তা রায়ান এসপানিয়ল, ডিটেনশন সেন্টারের মহাপরিচালক রবার্ট ব্রিংকাউ। বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানান আয়েবা মহাসচিব কাজী এনায়েত উল্লাহ।
সেখানে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই দালালের মাধ্যমে লিবিয়া কিংবা তিউনিশিয়ায় যান। সেখান থেকে বোটে রওনা হয়ে গ্রিস অথবা ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। কোনও কারণে যদি তাদের বোট ডুবে যায় কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হয়, তখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্ধার করে ইতালির দক্ষিণে অবস্থিত মাল্টা দ্বীপে এনে রেখে দেয়। সেখানে তারা রাজনৈতিক বা মানবিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন।
কাজী এনায়েত উল্লাহ বলেন, এখানে কয়েকটি বিষয় আছে। যারা এখানে এসে পৌঁছায়, তারা এক ধরনের ট্রমার মধ্যে থাকেন। আধামৃত অবস্থায়, দিনের পর দিন অভুক্ত অবস্থায় থাকেন। তাদের সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী জেরা করে, পরিচয় যাচাই করে। সেগুলো করার পরে যখন আবেদনে স্বাক্ষর করতে বলে তখন তারা করে দেয়। কীসের মধ্যে স্বাক্ষর করছে তা তারা বুঝতে পারে না। কারণ, এভাবে যারা এখানে আসেন, তাদের বেশিরভাগই মূলত কম শিক্ষিত এবং ভাষা জানেন না। যার ফলে নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে যা করতে বলে তাই করেন। এমনকি তারা যেভাবে বলেন সেভাবেই স্বাক্ষর করিয়ে নেন কাগজে। সমস্যা হচ্ছে– এখানে বাংলা অনুবাদকও কেউ নেই, আফ্রিকান অনুবাদক তাদের পড়ে শোনান। এসব নানা সমস্যায় পড়ে তারা এখনও জেলে।
সম্প্রতি মাল্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, আমরা তাদের বিষয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলাপ করেছি। এখানের নিয়মানুযায়ী ১৮ মাস ডিটেনশন সেন্টারে তারা রাখতে পারে, এরপর ছেড়ে দিতে হয়। মাল্টা সরকার তাদের বিষয়ে গ্রিসের বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়, কর্মকর্তারা তারপর আসেন এখানে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা এসে বাংলাদেশিদের আউটপাস দেন। মাল্টা সরকার তাদের দেশে ফেরত পাঠায়ে দেয়। ১৮ মাস থাকলে এমনিতেই মুক্তি দিয়ে দেয় মাল্টা সরকার। আরেকটা উপায় হচ্ছে কোর্টে মামলা করলে, সেক্ষেত্রে মামলা দায়েরের জন্য ২৫০ ইউরো এবং জামিনের জন্য ২ হাজার ইউরো দিতে হয়। তারপর বের হতে পারবেন। কিন্তু সে দেশে কাজ করতে পারবেন না। আমাদের বৈঠকে আলাপ হয়েছে এদের বিষয়ে এবং বৈধ পদ্ধতিতে কীভাবে সে দেশে কর্মী নেওয়া যায় সেটা নিয়ে।
এনায়েত উল্লাহ জানান, বাংলাদেশ থেকে মানুষ যেতে পারে মাল্টায়, কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি আছে তারা নিয়ে আসে। বিভিন্ন টেকনিক্যাল কাজে তাদের নিয়োজিত করা হয়। অনেকেই ভিসা নিয়ে আসেন, কিন্তু পরে মাল্টায় থাকেন না। তারা ইউরোপের অন্য দেশে চলে যান। যার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ওপর চাপ দিয়েছে। এ কারণে মাল্টায় কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক এখানে আছেই ৭০০-৮০০ জন। তার মধ্যে জেলে আছে ১৬৫ জন।
তিনি বলেন, আমরা সম্পূর্ণ মানবিক উদ্দেশে তাদের পরিবারের আকুতির ভিত্তিতে এই কাজটা করছি। আমরা মাল্টা সরকারকে সমস্যার কথা জানিয়েছি এবং বলেছি, যেভাবে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে তা যৌক্তিক নয়। আমি জানি এখানে প্রসিকিউশন কোর্টে আপিল করলে তারা মুক্তি পাবে। এজন্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি। আমরা সে দেশের সরকারকে বলেছি, সহজ উপায়ে তাদের মুক্তি না হলে আমরা কোর্টের মাধ্যমে মুক্তি করাবো। আমরা যার সঙ্গে মিটিং করেছি তিনি আমাদের অনুরোধ করেছেন মাল্টায় একটা শাখা করতে আমাদের সংগঠনের এবং তারা বৈধভাবে কর্মী আনার বিষয়ে বলেছে আমাদের। এই লোকগুলোকে মুক্ত করিয়ে আমাদের পরের প্ল্যান হচ্ছে এদের কাজের কথা বলে মানবপাচারের মতো কাজ করছে যারা, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থায় যাবো।
মাল্টায় টেকসই বাংলাদেশি কমিউনিটি তৈরি করে দিতে প্রতিনিধি দলের প্রতি দেশটির সরকার আহ্বান জানিয়েছে বলেও জানান এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, আমরা অবৈধভাবে অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করি। কিন্তু যে লোকগুলো এসে এখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের এখানেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। আমাদের সংগঠন ইউরোপে ১০ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
বাংলা ট্রিবিউন