জেলা প্রতিনিধি,বগুড়াঃ
বগুড়া শহরের রহমাননগর থেকে সাতমাথার দূরত্ব সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটার। এতটুকু পথ অটোরিকশায় যেতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ৬ মিনিট। কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার ঠিক আগের স্থান ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে এসে সময় হয়ে যায় এলোমেলো। বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি যাতায়াতের কারণে দিনের বেশিরভাগ সময় সৃষ্টি হয় যানজট।
এই কথাগুলো বলছিলেন মিজানুর রহমান নামে এক আইনের শিক্ষার্থী। এই যুবক বলেন, আমার কাজের সুবাদে প্রায় প্রতিদিন সাতমাথা, দত্তবাড়ি হয়ে উপশহর এলাকায় যেতে হয়। আর এই পুরো পথটাই যানজট থাকে। এসব যানজটের প্রথম কারণ রাস্তার ওপর সিএনজি অটোরিকশা, ইজিবাইকের স্ট্যান্ড।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বগুড়া পৌরসভার অভ্যন্তরে কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড নেই। যা আছে সবই সড়ক দখল দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ নির্দিষ্ট কোনো স্ট্যান্ড না থাকলেও সড়ক ইজারা দিয়ে অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে টোল আদায় করছে বগুড়া পৌরসভা। অথচ সড়ক ইজারা দিয়ে স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করাকে বেআইনি বলছে জেলার সড়ক বিভাগ। এমন ব্যবস্থাকে দুষছেন ট্রাফিক পুলিশ বিভাগও। তারা বলছে, সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
বগুড়া পৌরসভা আয়তনের দেশের বৃহৎ, প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার। শহরের কেন্দ্রবিন্দু ধরা হয় সাতমাথা এলাকাকে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা একাধিক পথের যোগাযোগ মিলেছে এই সাতমাথায়। এই প্রধান সড়কগুলো পৌরসভার মধ্যে হলেও সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাভুক্ত।
জেলার এই জিরো পয়েন্টের আশেপাশেও গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড। সেগুলোও সড়কের ওপর। এসবের মধ্যে পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গার ব্যবস্থা না করে চলতি অর্থবছরের জন্যে ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড় এলাকায় সিএনজি স্ট্যান্ড হিসেবে বগুড়া শেরপুর সড়ক ১০ লাখ ২০ হাজার ৩০০ টাকায় ইজারা দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। আর শহরের চেলোপাড়া এলাকার বগুড়া-গাবতলী সড়কের ইজারা মূল্য ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এর বাইরে মাটিডালি সড়কের দত্তবাড়ি, গোহাইল রোড, স্টেশন রোড ও ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের মহাসড়কের চারমাথায় সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড রয়েছে। নানা কারণে এগুলোর ইজারা হয়নি। সেজন্য পৌরসভা নিজেই খাস কালেকশন করছে এসব স্ট্যান্ড থেকে।অথচ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৪৭ ধারামতে নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত মোটরযান পার্কিংয়ের অপরাধে অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
জেলা বিআরটির তথ্যমতে, বগুড়ায় রেজিস্ট্রেশনকৃত সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ৭ হাজার ৬৫৮টি। জেলা পুলিশ ও পৌরসভার সূত্র বলছে, এর বাইরে আরও অন্তত ২০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা শহরে ঘুরে বেড়ায়।শহরের সবগুলো স্ট্যান্ড থেকে বগুড়া পৌরসভার নামে ১০ টাকা করে টোল আদায় করা হয়। এর বাইরে বগুড়া জেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠনের নামে ১০ টাকা আদায় করে স্ট্যান্ড পরিচালনাকারীরা। শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মালিক সমিতির নামে প্রতিদিন অন্তত ৬ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয় চালকদের। প্রতিমাসে সিএনজিচালকদের পকেট থেকে এই হিসাবে প্রায় ২ কোটি টাকা খসিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা।যানজট নিরসনের বদলে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে স্ট্যান্ড করায় অটোরিকশা চালকদের রয়েছে নানা অভিযোগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, পৌর টোল দিলেও পৌরসভা থেকে পার্কিংসহ কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব কথা কাউকে বলা যায় না।
পৌরসভা কোনোভাবেই সড়ক ইজারা দিতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, আমাদের হাইওয়ে বিভাগের যে-সব রাস্তা রয়েছে সেগুলো আমরা কোথাও ইজারা দেই না। এগুলোর ইজারা সম্ভব নয়। তবে পৌরসভার অভ্যন্তরে আমাদের কিছু কিছু সড়ক আছে। এরপরেও আমরা বিভিন্নভাবে শুনতে পেয়েছি, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এসব সড়ক ইজারা দিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। বলেছি, যেহেতু আমরা হাইওয়ের কোনো রাস্তা ইজারা দিইনি। অতএব অন্য কেউ এই ইজারা দিতে পারে না।
আর ট্রাফিক বিভাগ বলছে নিয়ম অমান্য করে পৌরসভার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছে এসব মোটরযান। এতে যানজট নিরসনের কাজের চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বগুড়া ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন রঞ্জন সরকার।তিনি বলেন, এটা আইনত অবৈধ। পৌরসভাকে বলা হয়েছে যে তারা যেন রাস্তার ধারে ফাঁকা স্থানগুলো ব্যবহার করে। রাস্তায় পার্কিং হিসেবে ইজারা দেয়ায় আমাদের যানজট নিরসনের কাজে বিঘ্ন ঘটছে। এতে আমাদের চ্যালেঞ্জ বাড়ছে।
ইজারা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, এই সিএনজি স্ট্যান্ড বন্ধ করার জন্য ২০২২ সালে ইজারা বন্ধ রেখেছিলাম। কিন্তু দেখা গেছে ইজারা বন্ধ থাকলেও যথারীতি সিএনজি স্ট্যান্ড ছিল। যথারীতি চাঁদাবাজি হয়েছে, টাকা উঠেছে। আমরা দেখেছিলাম বিভিন্ন সংগঠন মিলে এই চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায় কিনা। কিন্তু হয়নি। এ জন্য আবারও ইজারা দেয় বগুড়া পৌরসভা।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে যানজট নিরসনে বেশ কিছু সুপারিশ করেন বগুড়া পরিবেশ উন্নয়ন নাগরিক কমিটি। সংগঠনটি এসব সুপারিশ জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেছে বহুদিন। সেই সুপারিশের দৃশ্যমান কিছু আজও দেখা যায়নি।সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক বলেন, ‘এ শহরে মানুষ যত, গাড়িও তত হয়ে গেছে। ফলে যানজট দিনকে দিন বিষফোড়া হয়ে উঠছে। যেখানেই স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে, সেই এলাকায় সবসময় জট লেগে থাকে। শহরে কতোগুলো ভাড়ায় চালিত গাড়ি থাকা উচিত তার কোনো সুপরিকল্পনা নেই।
স্ট্যান্ডের জন্য সড়ককে ইজারা দেওয়ার প্রসঙ্গে আব্দুল খালেক বলেন, এটার অবস্থা এমন-চোর চুরি করবে তাই আমি আগেই চুরি করছি। এখানে যে যার মতো চলছে, যেন কিছু বলার নেই, করার নেই। প্রকৃতপক্ষে যানজট নিয়ে দায়িত্বশীল কোনো পক্ষের মধ্যেকার কাজে সমন্বয় নেই। তারা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অবশ্যই শহরকে যানজটমুক্ত দেখতে পাব আমরা।