জেলা প্রতিনিধি,খুলনাঃ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। উন্মুক্ত জলাধার হ্রাস পাওয়ায় তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এর প্রভাবে মানুষসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবধরনের প্রাণীরা। খুলনায় ১৩ হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। তাপের কারণে ঘেরে চিংড়ি মরছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানি খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা জরুরি।
সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থায়ন ও সমন্বিত উদ্যোগ কৌশল শীর্ষক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানা গেছে। সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্টজনরা অংশ নেন।সভায় বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে খুব বেশি দায়ী না হলেও বাংলাদেশ অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় দিন বাস্তুহীন, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ফসল, মৎস্য উৎপাদন কমছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশু স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
সভায় আরও বলা হয়, যে কোনও নীতিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিমত গুরুত্বপূর্ণ। ভুক্তভোগী ও সংকটাপন্ন মানুষ কীভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠবে বা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে তার সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। পরিবেশগত বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ কমানো, বৃক্ষরাজি গড়ে তোলা, নদী-খাল, হাওড়, বাওড়গুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশেষ অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা যথা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দেশী ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতিমালাগুলোর সমন্বয় করতে হবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতনভাবে এসব কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে।
অ্যাওসেড’র উদ্যোগে কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগিতায় ৩০ এপ্রিল বিকাল ৫টায় হোটেল ওয়েস্টার্ন ইন খুলনায় মাল্টি-অ্যাক্টর পার্টনারশিপ’স (এমএপি’স) অন ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইন্সুরেন্স (সিডিআরএফআই) প্রকল্পের আওতায় সিডিআরএফআই প্রচারের জন্য মাল্টি অ্যাক্টর প্ল্যাটফরম এর খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। সভায় সভাপতিত্ব করেন অ্যাওসেড’র নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফীন। সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান।
আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা, কুয়েট ইউআরপি বিভাগের প্রধান ড. তুষার কান্তি রায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান. খুলনা ওয়াসার প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জি এম মোস্তাফিজুর রহমান, মৎস্য দফতরের কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন, পানি অধিকার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির ববি, পরিবেশ দফতরের সহকারী পরিচালক মো. ইমদাদুল হক, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডেপুটি চিফ ড. মো. নজরুল ইসলাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি আসিফ আহমেদ, বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের মো. জুবায়ের হোসেন প্রমুখ।
আলোচনা সভা শেষে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে প্রধান করে একটি পরামর্শ কমিটি গঠন করা হয়। সভায় অংশ নিয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেটা আমরাও জানি, বিশ্ব নেতৃত্বও জানে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচা ও সুরক্ষা নিয়ে ভাবছি, পরিকল্পনা নিচ্ছি ও কাজ করছি। ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ৫৪টি নদীর ফয়সালা না হলে এর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। আমরা কাজ করে এক ফসলির জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করছি। কিন্তু পানি সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কারণ উজানের পানি নাই। সাগরের পানির ওপর ভরসা করায় লবণের মাত্রা বাড়ছে।’
সুন্দরবন সুরক্ষায় ঘষিয়াখালী খাল খনন করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যার সুফল এখন আমরা পাচ্ছি পুনঃখননের মাধ্যমে। ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৩টি খাল খনন করা হয়। কিন্তু সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। নিয়মিত খনন করতে হয়। উজানের পানি প্রবাহ আনতে ৫৪ নদীর সমাধান দরকার।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি আছে কৃষি ও পানির ওপর। ফ্রেশ পানি হ্রাস পাওয়ায় মাছ চাষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। ফলে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদনও বাঁধাগ্রস্ত। বৃষ্টি কমছে। তাপমাত্রায় পরিবর্তন হয়েছে। মৌসুমি বৃষ্টি নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। নওয়াপাড়া পর্যন্ত মিষ্টি পানি পাওয়া যেতো। এখন সেখানে লবণ পানি পৌঁছে গেছে। খাদ্য উৎপাদনের ওপরও প্রভাব দৃশ্যমান। যা উদ্বেগের বিষয়। মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মিটিগেশন ও অ্যাডাপটেশনের ওপর জোর দিতে হবে। সোসিও ইকোনমিক পলিসির ওপর পরিবর্তনের ওপর ফোকাস করে অ্যাডজাস্টের দিকে নজর দিতে হবে। ঝুঁকিগুলো শনাক্ত ও হ্রাস করার ওপর জোর দিতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কোন ফান্ড নেই। নিজস্ব উদ্যোগে পানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করছি। আগে তদারকি করতেন খালাসী। তাই সমস্যা হলে দ্রুত কবর আসতো। এখন ব্যবস্থাপনা কমিটির করতে হয়। কিন্তু নজরদারি দুর্বল হওয়ায় খবর পেতে পেতে বাঁধ ক্ষতি হয়ে যায়। সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়।’
পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ থেকে আসে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। এটাই আমাদের উদ্বেগের জায়গা। বায়ুমণ্ডলে কম কার্বন নিঃসরণ করতে হবে। পলিথিন উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ বেশি। আমাদের পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে ১০০ টন পলিথিন ব্যবহার হয়। যার ৫০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। আর বাকী ৫০ শতাংশ বাইরে থেকে আসে। এ ব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান, জেল জরিমানা করা হচ্ছে। পৃথিবী তার কক্ষপথ পরিবর্তন করলে জলবায়ু পরিবর্তন হবে। দশমিক ৭ শতাংশ কার্বনডাই অক্সাইড মনুষ্য সৃষ্ট কারণে হয়। যা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর তার সাধ্যমতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। খুলনা অঞ্চলে তিনটি মনিটরিং কেন্দ্রে বায়ু দূষণ রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।’
প্রাণী সম্পদ বিভাগের উপ প্রধান কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তাপপ্রবাহে ব্যাপক ক্ষতি। ১৩ হাজারের ওপরে মুরগি মারা গেছে। প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। হিটের সময় ছায়া স্থানে রাখা ও তিনটার আগে মুরগীকে খাবার না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’ কুয়েট অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. তুষার কান্তি রায় বলেন, ‘ময়ূর নদী ও ২২ খাল বেদখল। ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খনন কাজ চলছে। ওয়াকওয়ে করা, গাছ লাগানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে খাল উদ্ধার করা প্রয়োজন। এখন কেবল শহরেই নয়। গ্রামেও বাড়ি করতে হলে প্ল্যান নিতে হচ্ছে। এগুলো কিন্তু পরিকল্পিত কাজেরই নিদর্শন। জলবায়ু পরিবর্তন, শহরায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আসিফ আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবর্তনে হেলদি সিটির কাজ শুরু হয়েছে। এখন ক্লিন সিটির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান। সেচ পানির সমস্যা, তেরখাদা, ডুমুরিয়ায় জলাবদ্ধতা, কৃষি শ্রমিক স্বল্পতা, বেড়িবাঁধ সমস্যা রয়েছে। নদী ও খাল খনন করাসহ স্লুইস গেট সংস্কার করা প্রয়োজন। খাল ইজারা মৎস্য চাষীদের দেওয়ায় কৃষকরা পানি পায় না। কিন্তু সরকার নামমাত্র রাজস্ব নেয়। একই রাজস্বে প্রকৃত কৃষক পেলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। খালেও পানি প্রবাহ গতিশীল থাকবে। জলাধার থাকতে হবে। জলাধার নেই বলেই হিট ওয়েভও বাড়ছে।’
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়নের জিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রকৃতিকে বাঁধাগ্রস্ত করলে প্রকৃতি সেভাবেই ফিড ব্যাক দেবে। ১৯৭৩ সালে জরিপে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। ২০০০ সালের জরিপে লবণাক্ততার মাত্রা ১ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ততা ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। ২০২১ সালের জরিপের ফলাফল আগামী নভেম্বরে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত লবণাক্ত হয় ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি। উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়।’
তিনি বলেন, মার্চ মাসে ৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবল ছিল লবণাক্ততা, যা এপ্রিল মাসে ২৩ দশমিক ৭৭ ডেসিবলে উন্নীত হয়। বৃষ্টি কমলে বেড়ে যায়। আগে আমন চাষের পর জমি পতিত থাকতো। এখন ভুট্টা, সূর্যমুখীসহ লবণসহিষ্ণু ধান চাষ হচ্ছে।