জেলা প্রতিনিধি,রংপুর:
রংপুর তিস্তা, ঘাঘট, করতোয়াসহ অসংখ্য নদ-নদী বেষ্টিত এলাকা। বিশেষ করে তিস্তা ও ঘাঘট যেন বালুময় প্রান্তর। এসব নদী থেকে বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বালু খেকোরা। যেন বালু ব্যবসায়ীদের স্বঘোষিত বালুমহালে পরিণত হয়েছে নদীর পেট।
প্রতিদিন অবৈধভাবে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এসব এলাকা থেকে। স্থানীয় বাজারে যার মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা। আর সেই বালু রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপনা নির্মাণ ও খাল ভরাটের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ জেলা প্রশাসন কর্তৃক ইজারা দেওয়া বালুমহালে নেই ক্রেতা।
অবৈধভাবে বালু বাণিজ্য অব্যাহত থাকায় একদিকে যেমন সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে অন্যদিকে হুমকিতে রয়েছে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমি। স্থানীয় প্রশাসনকে এক প্রকার ম্যানেজ করে অবৈধ বালু ব্যবসা নির্বিকারে চলছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার কিছু পুলিশ সদস্য, তহশীল অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটে তৈরি হয়েছে এসব অবৈধ বালুমহাল। সাধারণত ভ্রাম্যমাণ আদালত হয় দিনের বেলায় আর রাতে বালু উত্তোলন বেশি হয়। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই খবর দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে জেল-জরিমানা করলেও দু-একদিন কর্মযজ্ঞ বন্ধ রেখে পুনরায় বালু উত্তোলন শুরু করে সিন্ডিকেট চক্রটি।
গত বৃহস্পতিবার (২ মে) দিবাগত রাতে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ১১নং বড়বালা ইউনিয়নের একটি অবৈধ বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনের সময় চালকসহ একটি ট্রাক জব্দ করে মিঠাপুকুর থানা পুলিশ। পরে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দেনদরবারে ঘটনাস্থল থেকে ট্রাকসহ অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মিঠাপুকুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, অবৈধ বালুসহ যে ট্রাকটি ধরা হয়েছে, সেটির চালক একসময় মাদকাসক্ত ছিল, তাকে ফেরাতে এবং তার কর্মসংস্থানের জন্য ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সেটি কিনে দেয়, তাই চেয়ারম্যানের অনুরোধে সে আর কোন অবৈধ বালু উত্তোলন করবে না শর্তে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম সরকারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ট্রাকের চালক এলাকার গরিব ছেলে, সে একটা পুরাতন ট্রাক কিনে চালায়। যেহেতু প্রথমবার সে অবৈধ বালু উত্তোলন করেছে, তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুরোধে শেষবারের মতো ট্রাকসহ তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমি ওসিকে অনুরোধ করেছি। সেই সঙ্গে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছি এবং অবৈধ বালু উত্তোলনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি।
সরেজমিনে রংপুরের নদীবেষ্টিত বিভিন্ন উপজেলাগুলো ঘুরে দেখা মেলে বালু উত্তোলনের নানা চিত্র। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শ্যালো মেশিন এবং শুকনো চরে কোদাল ও বেলচা দিয়ে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তিস্তা নদী এলাকার পয়েন্টগুলো হলো- মহিপুর তিস্তা ব্রিজের নিচ, মহিপুর, গান্নারপাড়, ধামুর বোল্লারপাড়, দক্ষিণ কোলকোন্দ সিংগীমারী, দক্ষিণ কোলকোন্দ গ্রোইন বাঁধ, দক্ষিণ কোলকোন্দ বাবুপাড়া, পাইকান ব্যাঙপাড়া ও পাইকান পীরপাড়া, উত্তর চিলাখাল, পূর্ব ইচলী ও মধ্য ইচলী। আর ঘাঘট নদের যেসব জায়গা থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পাইকান ডাক্তারপাড়া, পাইকান চওড়াপাড়া, পাইকান দোলাপাড়া, পাইকান বগুলাগাড়ী, দক্ষিণ পানাপুকুর ফকিরপাড়া সংলগ্ন বাগানবাড়ী, বেতগাড়ী মুন্সিপাড়া ও বেতগাড়ী বালাপাড়া।
এছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে মৎস্য প্রকল্পের নামে খাল খনন করে মাটি ও বালু বিক্রি করা হচ্ছে। এসব স্থান থেকে বালু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে, কেউ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা কৌশলে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর ধরে বালু ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া সদরের দমদমা, হারাগাছের মায়াবাজার ও মণেয়াচর, পীরগাছা, মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জসহ উপজেলাগুলোর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতি বছর গঙ্গাচড়া উপজেলা থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ঘনফুট বালু ও ভিটি বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ৫৫ শতাংশ তিস্তা নদী থেকে, ৩০ শতাংশ ঘাঘট নদ থেকে এবং অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ বিভিন্ন স্থানের মৎস্য প্রকল্পের খননকৃত খাল থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব বালু ও ভিটি গঙ্গাচড়া উপজেলাসহ রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের পরোক্ষ মদদেই অবৈধ বালু ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে। এতে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় বেশ কিছু প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীও। প্রশাসন সক্রিয় হলে নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হতো।
রংপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলায় একটি মাত্র সরকারি বালুমহাল রয়েছে। যেটি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তরফসাদী মৌজায় অবস্থিত। যা ইতোমধ্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাকি আরও চারটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বর হাসান বলেন, রংপুরে শুধুমাত্র একটি বৈধ বালুমহাল রয়েছে। যা জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাকি সব অবৈধ। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে জেলা প্রশাসন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে মোবাইল কোর্ট অভিযান অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে অনেক পয়েন্ট থেকে বালু এবং বালু উত্তোলনের সরঞ্জামাদি আটকসহ জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ টিম সবসময়ে সোচ্চার। অবৈধ বালু উত্তোলনে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা বা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। কিন্তু তা না মেনে এলাকার প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন।