খেলাধুলা ডেস্ক:
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আতুড়ঘর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। খেলা-ধূলা প্রাধান্য হলেও এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিকেএসপি’র পাঁচ শিক্ষার্থী জিপিএ-ফাইভ পেয়েছেন। পাঁচ জনের মধ্যে দুই জন নারী হকি দলের। দুই জন যমজ বোন হীমাদ্রি বড়ুয়া সুখ ও নীলাদ্রি বড়ুয়া নীল।
১৯৮৬ সালে ফুটবল দিয়ে বিকেএসপির যাত্রা শুরু। পরের বছর হকি অর্ন্তভুক্ত হয়। পুরুষ হকি বিকেএসপির প্রায় জন্মলগ্ন থেকে থাকলেও নারী হকি শুরু হয়েছে বছর চারেক আগে। নীলাদ্রি-হীমাদ্রি দুই বোন বিকেএসপি নারী দলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ২০২১ সালে তারা সপ্তম শ্রেণীতে নারী হকিতে ভর্তি হয়েছেন।
সকাল-বিকেল দু’বেলা অনুশীলন করে পড়াশোনায় মন বসে না বিকেএসপির অনেক শিক্ষার্থীরই। তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম দুই যমজ বোন। হীমাদ্রি অনেক কষ্টের পর ফল পাওয়ায় বেশ তৃপ্ত, ‘আসলে অনেক পড়াশোনা করেই এই ফল পেয়েছি। আমাদের স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা যেমন আন্তরিক ছিলেন তেমনি খেলাধূলার স্যাররাও। পরীক্ষার আগে অনুশীলন মাঠে আমরা বই এনে পড়েছি।’ খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ভালো করা সম্ভব বলে মনে করেন বিকেএসপির এই নারী গোলরক্ষক, ‘আসলে পড়াশোনা নিজের কাছে। এখানে হোস্টেল লাইফ। অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকে। গল্প-আড্ডা হাসিতে অনেক সময় নষ্ট করে। আমরা পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিয়েছি। তাই ভালো ফল পেয়েছি।’
যমজ ভাই-বোনের অনেক পছন্দ-অপছন্দ একই হয়। নীলাদ্রি ও হীমাদ্রীর ক্ষেত্রেও একই ঘটেছে। দুই বোনই হকিতে ভর্তি হয়েছেন। দুই জনই বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। নীলাদ্রি সকল বিষয়ে ৮০ উর্ধ্ব নম্বর পেলেও হীমাদ্রী ইংরেজীতে ৮০’র কম পেয়েছেন। তাই তিনি এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘ইংরেজী পরীক্ষাও ভালো হয়েছে। আমি রিচেকের আবেদন করব। আশা করি এটাতেও ফাইভ আসবে।’
দুই বোনের খেলাধূলা, পড়াশোনা ও ফলাফল একই এই প্রসঙ্গে নীলাদ্রি বলেন, ‘আসলে আমাদের মধ্যে মানসিকভাবেও অনেক মিল রয়েছে। দুই জনই ছোট বেলায় খেলতে পছন্দ করতাম। দুই জনই ছোটবেলায় স্কুল ছুটির দিন ক্রিকেট খেলতাম। বিকেএসপিতে ক্রিকেটে ভর্তি হতে এসেছিলাম। রাজু স্যার (বিকেএসপির হকি কোচ) আমাদের দেখে হকিতে নিয়ে আসেন।’
আজ ফলাফল দেয়ার কিছুক্ষণ পরই দুই বোন স্টিক-গ্লাভস নিয়ে বিকেএসপির হকি টার্ফে। সিঙ্গাপুরে এএইচএফ অ-২১ নারী টুর্নামেন্টের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্পে রয়েছেন দুই বোন। বিকেএসপি’র নারী দলের কোচ জাহিদ হোসেন রাজু ফেডারেশনের অ-২১ দলের কোচিংও করাচ্ছেন বিকেএসপিতে। দুই যমজ বোন সম্পর্কে তার মন্তব্য, ‘তারা চট্টগ্রামে শিক্ষিত বৌদ্ধ পরিবারের সন্তান। তাদের বাবা চট্টগ্রামে একজন শিক্ষিত ও ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তি। তার অনুপ্রেরণায় মেয়েরা ক্রিকেটে আগ্রহী ছিল আমি তাদের উচ্চতা দেখে হকিতে আনি। হকিতেও ভালো করছে। পড়াশোনায় যেমন তারা ভালো হকিতেও তাদের ভবিষ্যত ভালো।’
সত্তরের দশকে নারী হকি দলের পথচলা শুরু হলেও এরপর দীর্ঘদিন থেমে ছিল। ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে এইচএফের একটি নারী হকি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর দীর্ঘদিন নারী কার্যক্রম সেভাবে করেনি হকি ফেডারেশন। গত বছর ওমানে ফাইভ এ সাইড একটি টুর্নামেন্টে অবশ্য অংশ নিয়েছিল নারী দলও। সেই টুর্নামেন্টের ক্যাম্পে ছিলেন এই দুই বোন। এবারও অ-২১ দলের ক্যাম্পে আছেন।
পড়াশোনা ভালো করা দুই বোনের এখন লক্ষ্য সিঙ্গাপুরে অ-২১ দলে জায়গা করে নেয়া, ‘গতবার ফাইভ এ সাইডে আমরা ওমানে যেতে পারিনি। এবার লক্ষ্য থাকবে মূল দলে জায়গা করে নেয়া।’ দুই বোনই খেলাধূলার সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান সমানভাবেই, ‘যেহেতু বিকেএসপিতে এসেছি খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নে ফলে জাতীয় দলে খেলাটাই প্রধান লক্ষ্য। এর পাশাপাশি এইচএসসিতেও জিপিএ ফাইভ পেতে চাই। আপাতত এ রকমই ভাবনা। এরপর ভাবব পরবর্তী লক্ষ্য।’
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এবার ২৭৫ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে ২৬৫ জন উত্তীর্ণ ও ১০ জন ফেল করেছেন। ২৭৫ জনের মধ্যে সাভার বিকেএসপি থেকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬২ জন। এদের মধ্যে চার জন জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। চার জনই বিজ্ঞান বিভাগের। দুই যমজ বোন ছাড়া অন্য দুই জন জিপিএ ফাইভ প্রাপ্ত হলেন ক্রিকেটের অচেনা জান্নাত ইমান্তাগ ও তায়কোয়ান্দোর আশিক পিকে। আঞ্চলিক বিকেএসপি থেকেও একজন জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোঃ মোতাহের হোসেন শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলাফল সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা সুশিক্ষিত ক্রীড়াবিদ গড়ে তুলতে চাই। খেলার পাশাপাশি শিক্ষাও অত্যন্ত প্রয়োজন। পরিপূর্ণ ক্রীড়াবিদ হতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এবার ঢাকা বোর্ডে শিক্ষার হার ৮৩.৯২ ও সামগ্রিকভাবে ৯৬.৩৬। সামনে এটি আরো উন্নতি করার চেষ্টা থাকবে।’
বয়স ভিত্তিক নারী ও পুরুষ ফুটবল দলে অনেকেই এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নারী ফুটবল দলের মধ্যে ঐশী ঢাকা বোর্ড থেকে ৪.৪৪ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। উমেলহা মারমা পেয়েছেন ৪.০০। সুলতানা, রুমা, পুজা, কাননও এসএসসি পাশ করেছেন। কমলাপুর স্টেডিয়ামে বাফুফের এলিট একাডেমীতেও পাঁচজন ছাত্র এসএসসি পাশ করেছেন। পাঁচ জনের মধ্যে আবার তিন জন বিকেএসপির। রাজু ও আশিক টাঙ্গাইলের বিদ্যালয় থেকে জিপিএ- এ (৪) পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বিকেএসপি ও দেশের শীর্ষ খেলা ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলার অনেকেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সেই সকল তথ্য অবশ্য সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনগুলোতে নেই। সাবেক ক্রীড়াবিদ, কোচদের সন্তানদের অনেকে পরীক্ষার্থী ছিলেন এবার। তাদের কেউ কেউ জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। দেশের শীর্ষ স্থানীয় কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। তার ছেলে সানদিদ এবার প্রিমিয়ার বিভাগ ক্রিকেট লিগে নিবন্ধিত খেলোয়াড় ছিলেন। খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও তিনি পারদর্শী। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।