বাজেটের মূলনীতি হোক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে মানুষের জীবন সহজ করা

অর্থনীতিবিদদের অভিমত

প্রকাশিত: ৯:০২ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০২৩

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা
বুধবার, ২৪ মে ২০২৩, ১০ জ্
আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে : প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে ভোটগ্রহণ জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী আগামীকাল বাজেটের মূলনীতি হোক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে মানুষের জীবন সহজ করা: অর্থনীতিবিদদের অভিমত শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকিতে বিএনপির মৌন সম্মতি আছে : ওবায়দুল কাদের
শিরোনাম
বাজেটের মূলনীতি হোক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে মানুষের জীবন সহজ করা: অর্থনীতিবিদদের অভিমত
বাসস

২৪ মে ২০২৩, ১৩:৪৩
আপডেট : ২৪ মে ২০২৩, ১৭:০০
facebook sharing buttontwitter sharing buttonemail sharing buttonsharethis sharing button

ঢাকা, ২৪ মে, ২০২৩ (বাসস) : মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হবে। তাই, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করে সাধারণ মানুষের নির্বিঘœ জীবনচলার বিষয়টি অবশ্য অগ্রাধিকারের দাবি রাখবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কোভিড পরবর্তী এই সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের মূলনীতি হিসেবে দেখা উচিত। দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বাসসের কাছে এমন অভিমত তুলে ধরেছেন।
আগামী ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। এটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট।
ড. আতিউর রহমান বলেন, আগের দু’টি জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনার সময়ই আমরা বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। ২০২১-২২-এর বাজেট যখন মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল তখন মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল করোনাজনিত সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের নীতিকৌশল। তার পরের বছরের বাজেটে ভাবতে হয়েছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে। এবার, অর্থাৎ আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময়ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অভাবনীয় মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে বাজেট প্রণেতাদের।
তিনি মনে করেন, মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হবে। তাই, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করে সাধারণ মানুষের নির্বিঘœ জীবনচলার বিষয়টি অবশ্য অগ্রাধিকারের দাবি রাখবে। আসন্ন বাজেটকে তাই একাধারে খুবই সতর্কতার সঙ্গে প্রণয়ন করতে হবে, অন্যদিকে নয়া পথের সন্ধান দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট হতে যাচ্ছে এবারেরটি। তাছাড়া, আইএমএফের কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট বেশকিছু শর্তপূরণের বাড়তি চাপও রয়েছে। সার্বিক বিচারে নিছক আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, বরং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক দলিল হিসাবে এবারের বাজেটটি আলাদা তাৎপর্যের দাবিদার। বিশেষ করে ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্য ও সেবা মূল্য পরিস্থিতির মাঝে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব কী করে সমাবেশ করা যাবে নীতি-নির্ধারকদের সেই দুশ্চিন্তার কথাটি নিশ্চয় উপেক্ষা করার মতো নয়। এজন্য বাড়তি করক্ষেত্র সন্ধান এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে করছাড়ের সুযোগ সংকুচিত করতেই হবে।
তিনি মনে করেন, আগামী বাজেটে প্রথমত করকাঠামোতে ব্যাপক সংস্কার করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে সম্পদ করের আধুনিকায়ন দরকার। ধনীক শ্রেণির সম্পদের দাম বাজার মূল্যে নির্ধারণ করে তাতে কর বসানো জরুরি। এখন যে ব্যবস্থা আসছে তাতে প্রচুর ছাড় দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে আয় করের হার ধনীদের জন্য বাড়ানো উচিত। অন্য দিকে ন্যুনতম করসীমা বাড়ানো উচিত।
দ্বিতীয়ত-কম আয়ের মানুষগুলোর আয় রোজগারের সুযোগ বাড়ানোর দরকার রয়েছে। তারা যাতে সহজেই দেশে এবং বিদেশের শ্রম বাজারে ঢুকতে পারে সেজন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা দরকার। কৃষি ঋণ ও এমএসএমই ঋণের পরিধি বাড়ানো উচিত। এসব ক্ষেত্রে নারী উদ্যেক্তাদের প্রাধান্য দিতে হবে।
তৃতীয়ত-সবুজ উন্নয়নের জন্য কার্বন কর আরোপ এবং সোলার সেচ ব্যবসা গড়ে তুললে সমাজে দীর্ঘমেয়াদি সুসম উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হবে। চতুর্থত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি বিনিয়োগ করলে দারিদ্র্য নিরসনের হার আরও বাড়বে। ফলে, সমাজে আয় বৈষম্য কিছুটা কমবে।
আতিউর রহমানের বলেন, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী এবং বিশেষজ্ঞরা বারবার এ সংকটকালে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। তবে, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কিংবা ভর্তুকি দেওয়ার মতো পথে না হাঁটার পরামর্শই বেশি বেশি আসছে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়ার কারণে যাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দরকার তাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যয় বেড়ে যায়। তার চেয়ে যথাযথ টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে আসলেই যাদের সহায়তা দরকার, তাদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছানোটিই বেশি কার্যকর।
তিনি মনে করেন নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা মসৃন করতে চরাঞ্চল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এলাকা, নগর দরিদ্র এভাবে ‘পোভার্টি পকেটস’গুলোকে আলাদা চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য উপযোগী বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চয়ই বড় চ্যালেঞ্জ। আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কোভিড পরবর্তী এই সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা। তিনি মনে করেন, বর্তমানে উচ্চ মুল্যস্ফীতি ও সম্পদ সংকুলান যেমন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে একইসাথে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ রয়েছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, চাহিদা ও যোগানের মধ্যে অসমাঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে। আইএমএফ এর কিছু শর্ত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, কোভিড অতিমারির কারণে অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে। তাই, এসব জায়গায় বিনিয়োগ ও প্রাপ্তি বাড়াতে হবে। নি¤œ আয়ের মানুষকে কিভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়-সেসব কর্মসূচির প্রতি বেশি নজর দেওয়ার প্রয়োজন। সিপিডির এই ফেলো বলেন, খাদ্য সহায়তা প্রদানে সরকার ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করছে এবং এর সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেড় কোটি করার ঘোষণা দিয়েছে। সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, নগর দরিদ্ররা সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নেই।তাদের জন্য ওএমএস এর পাশাপাশি রেশন পদ্ধতি চালু করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বাজেটের আকার খুব বড় হয় বলে মনে করি না। এবার বাজেটের আকারের কথা যেটা শুনছি, তা জিডিপির ১৫ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে। এর মধ্যে সম্পদ আহরণ থাকবে ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ। ঘাটতি বাজেট হিসেবে সাথে ৬ শতাংশ যোগ করলে বাজেট জিডিপির ১৫ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশের বেশি হবে না।
মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সম্পদ আহরণের দিক থেকে প্রত্যক্ষ কর কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। যারা কর দিচ্ছেন তাদের উপর অহেতুক চাপ সৃষ্টি না করে করের ভিত্তি আরও বাড়াতে হবে। দেখতে হবে ডিজিটাইলাইজেশনের মাধ্যমে নতুন করদাতা কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত শক্তি, জনবল বৃদ্ধি এবং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। এসব উদ্যোগ সরকারকে রাজস্ব আহরণে সহায়তা করবে।
তিনি মনে করেন, বাজেটে কর ফাঁকি রোধের উদ্যোগ থাকাটা জরুরি। এছাড়া আয়কর আইন ও কাস্টমস এক্টসহ বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশেষ মনোযোগ থাকতে হবে।
জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ নতুন প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এবার অবকাঠামোতে ব্যয় না বাড়িয়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাখাতে অগ্রাধিকার থাকা ভাল। সেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সুষ্ঠভাবে বিতরণ করা জরুরি।
তিনি বলেন, ব্যয়ের দক্ষতা বাড়ানোর আব্যশকতা রয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে দেখা যায় অবকাঠামো হচ্ছে কিন্তু সেখানে প্রশিক্ষিত জনবল নেই। তিনি মনে করেন, শিক্ষাখাতে কোভিডের সময় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাখাতে কার্যকর ব্যয় কিভাবে করা যায়-সেদিকে নজর রাখার প্রয়োজন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেখতে হবে ঘাটতি অর্থায়নের কারণে বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ যেন বাাঁধাগ্রস্ত না হয়। ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে বরং বিদেশী ঋণের প্রতি বেশি নজর দিতে হবে।
তিনি এবারের বাজেটে ভর্তুকি পুনবিন্যাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। তিনি মনে করেন, ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে আইএমএফ এর পরামর্শ থাকবে। কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রাধিকার দেওয়াটা অতি জরুরি। দেখতে হবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেন না কমে। বরং সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অদক্ষতার কারণে ভর্তুকি বেশি যাচ্ছে, সেখানে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে নীতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
এই অর্থনীতিবিদের মতে, বর্তমান সময়ে রিজার্ভের ওপর যেহেতু চাপ রয়েছে, তাই, বিদেশী ঋণ ও বাজেটারী সহায়তা দক্ষতার সাথে ব্যয় করতে পারলে রিজার্ভের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির চেয়ে আমাদের নজর রাখতে হবে কিভাবে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে স্বস্তি দেওয়াটা হতে হবে আসন্ন বাজেটের মূলনীতি। এর জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো, প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করার বিশেষ উদ্যোগ যেন বাজেটে থাকে। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে শুল্ক-কর ছাড় দিতে হবে। এছাড়া, ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি আরও জোরদারের পরামর্শ তাঁর।
আইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তাই, গতানুগতিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার উপযোগী বাজেট প্রনয়ণের পরামর্শ দেন তিনি।