নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘নদী গরীব-দুঃখি বোঝে না বাহে। বুঝলে কি আজই হামাক চিন্তাত থাকা নাগে। ভাঙতে ভাঙতে তিস্তা নদী হামার বাড়ির বগলোত (কাছাকাছি) চলি আলছে (এসেছে)। মোর ছাওয়াগুল্যা (ছেলেদের) কত কষ্ট করি এই বাড়ি কোনা বানাইচে। সেটাও বুঝি কাড়ি নেয়। হামার মাথা গোজার জাগা (জায়গা) থাকে না। প্রত্যেক বছর সময়ে-অসময়ে নদী ভাঙতে থাকে। যদি সরকার হামার এত্তি একান বড় বাঁধ করি দেইল (দিলে) হয়, তাইলে হামার এদোন (এরকম) কষ্ট হইল না (হতো না) হয়।’অশ্রুসিক্ত চোখে আগ্রাসী তিস্তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী মজিরন নেছা। তিস্তা নদী বেষ্টিত রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই গ্রামের বাসিন্দা তিনি। গত কয়েক দিনের সামান্য বৃষ্টিতে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে ভাঙন ঝুঁকিতে আছে মজিরন নেছার পোশাক শ্রমিক সন্তানদের কষ্টে গড়া আধা পাকা বাড়িটি।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রংপুর অঞ্চলে সময়ে-অসময়ে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের স্থায়িত্ব অল্প সময়ের হলেও ক্রমান্বয়ে পানি বাড়তে শুরু করেছে তিস্তায়। এর ফলে অসময়েই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে নদীটি। শুরু হয়েছে ভাঙন। গত কয়েকদিনে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার প্রায় ১৫টি বসতঘর ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি হুমকিতে রয়েছে এই উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাইসহ আশপাশের তিন গ্রামের কয়েক শ বসতভিটা, স্কুল ও মসজিদ।
সোমবার (৩ জুন) বিকেলে বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তার দক্ষিণ তীরে গত দুই বছর ভাঙতে ভাঙতে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণে সরে এসে ঠেকেছে বাঁধে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলছে ভাঙন রোধে।
স্থানীয়রা জানান, তিস্তার পরিবর্তিত গতিপথ এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অচিরেই বিচ্ছিন্ন হবে লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ। নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে তিনটি গ্রামের অসংখ্য বাড়িঘরও।
গদাই এলাকায় মানুষের অভিযোগ, তিস্তা তাদের স্বপ্ন ও সহায় সম্বল কেড়ে নিয়েছে। এখন নতুন করে আবারো অনেকের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। বাঁধ রক্ষায় সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে আবেদন জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয় কৃষক রশিদুল ইসলাম, বিজয় সরকার, ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার মিয়া, কলেজছাত্র রুহুল আমিনসহ বিভিন্ন বয়সী অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা তিস্তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া এসব মানুষ জানান, ‘তিস্তা নদী গত তিন বছরে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করে অসংখ্য বাড়ি ও ফসলি জমি গিলে খেয়েছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে কাউনিয়ার রেলস্টেশন। এই রেলস্টেশনকে তিস্তার কবল থেকে বাঁচাতে দেওয়া হয়েছিল একটি বাঁধ। সেটিও অসময়ের বৃষ্টিতে প্রায় অর্ধেক ভেঙে গেছে। তাই দ্রুত কার্যকারী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি নদী বিশেষজ্ঞদের।’
এদিকে প্রতিবছর তিস্তা নদীর পানিতে কাউনিয়া উপজেলার গদাই ছাড়াও পাঞ্জরভাঙ্গা, নিচপাড়া, তালুকশাহবাজ, ঢুসমারা এবং হরিশ্বর গোপিভাংগা; টেপামধুপুর ইউনিয়নের চরগনাই, হযরত খাঁ; হারাগাছ ইউনিয়নে চর নজিরদহ শহীদবাগ এবং চর নজিরদহ এলাকার মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে বলে জানা গেছে। বর্ষার আগে এসব স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্কারমূলক কাজ শুরু না করলে ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, বর্ষা এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। এখন সামান্য যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতেই নদীতে পানি বাড়ছে। এতে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। যদি বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মেরামত করত, তাহলে মানুষের ভোগান্তি অনেক কমে যেত। ভাঙন ঝুঁকি থেকে অনেকেই স্বস্তিতে থাকতে পারত।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, বর্ষার আগেই ভাঙন প্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে জিও ব্যাক ফেলার কাজ অব্যাহত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ভাঙন এলাকাগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ওই স্থানগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।
নদীবিষয়ক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’ এর পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, উজান থেকে নেমে আসা পানিতে পলি জমে তিস্তার পেট ভরাট হচ্ছে। ফলে এবার তিস্তার আগ্রাসী ভাঙন প্রতিরোধ সহজ হবে না। এই নদীকে নিয়ে কার্যকরী দ্রুত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এবারের বন্যায় তিস্তা রুদ্র রূপ ধারণ করতে পারে। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এখনই নদীর ভাঙন পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূল্যের তিস্তা মহাপরিকল্পনা নামক সোনার হরিণের দেখা কবে মিলবে, সে অপেক্ষায় উত্তরাঞ্চলের মানুষ। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ উত্তরের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সুফল আসবে। এর ফলে নদী পথের যোগাযোগ তৈরি হবে। স্যাটেলাইট শহর হবে, আবাদি জমি বাড়বে। ফলে মানুষের জীবন মানে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। বর্ষায় ভাঙন, প্লাবন এখন দীর্ঘ দুর্যোগে রূপ নিয়েছে আর শুষ্ক মৌসুমে বন্ধু দেশ ভারতের পানি প্রত্যাহারে মরতে বসেছে তিস্তা। সে কারণে ২ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান জানান, মঙ্গলবার (৪ জুন) সকাল ১০টা পর্যন্ত রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়সহ বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির স্থায়িত্ব ছিল ২০ মিনিট। এ সময় ১৭২ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের পাশাপাশি বাতাসের বেগ বেশি ছিল।