প্রধানমন্ত্রীর ভারত-চীন সফর: দেশের উন্নয়নে ‘ভারসাম্যের কূটনীতি
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
আঞ্চলিক উদীয়মান দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের কড়া নজর রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে দেশ দুটি। এটিকে কাজে লাগানোর কৌশল নিয়ে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি অনুসরণ করেই টানা চার মেয়াদে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর ও আসন্ন চীন সফরও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তারা বলছেন, পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দিল্লি-বেইজিংয়ের ক্ষেত্রে দেশের উন্নয়নে ‘ভারসাম্যের কূটনীতি’ চলছে, চলবে। এটিকে ‘উন্নয়ন কূটনীতি’র এপিঠ-ওপিঠও বলা যায়।
পররাষ্ট্র বিষয়ে কাজ করেন, আওয়ামী লীগের এমন অন্তত তিন জন নেতা একান্ত আলাপচারিতায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফর ছিল নির্ভার। আসন্ন চীন সফরও এমনই হবে। এই নির্ভারতা অতীতের ধারাবাহিকতারই অংশ। অর্থাৎ উভয় দেশের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়টি সবপক্ষের কাছে পরিষ্কার এবং তা নিয়ে কোনও পক্ষের উল্লেখযোগ্য বিরোধ নেই। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফর দিল্লি ও বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বরং দেশের উন্নয়নে এই ভারসাম্যের কূটনীতি ইতিবাচকই হবে।
ভারত-চীন সফর নিয়ে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তাদের ভাষ্য হলো— বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশে প্রভাব বিস্তারের এক ধরনের প্রতিযোগিতা করছে ভারত ও চীন। উভয় দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চার মেয়াদেই সরকার ‘উন্নয়ন মডেল’ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং চীন অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। উভয় দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলায় গত ১৫ বছর ধরেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর রাজনৈতিক সুবিধাও পেয়ে আসছে আওয়ামী লীগ সরকার। পরীক্ষিত এই কৌশল অব্যাহত রেখে দিল্লি ও বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার করতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
তারা মনে করেন, উন্নয়ন মডেল এগিয়ে নিতে ঢাকার ভারসাম্যের কূটনীতি এখন আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের ফলাফল আসন্ন চীন সফরের পরে আরও স্পষ্ট হবে। তার দিল্লি ও বেইজিং সফর ভিন্ন ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেটি বিবেচনায় নিয়েই উভয় দেশের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা সই করা হয়েছে এবং হবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের অভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা হলো— দেশের উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া। উভয় সফরের কূটনৈতিক উদ্দেশ্য হলো— উন্নয়নে ভারসাম্য বজায় রাখা। আর ভারত সফর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং চীন সফর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে সূত্রগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরকে আমরা অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছি। এটা আওয়ামী লীগের বেসিক পলিসি। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, আওয়ামী লীগও অনুসরণ করে— ফ্রেন্ডশিপ টু অল কান্ট্রি, সমানভাবে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। আমাদের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখে সমতার ভিত্তিতে, সমমর্যাদার ভিত্তিতে এই বন্ধুত্ব। এ ক্ষেত্রে আমরা অর্থনৈতিকভাবে যতই ছোট দেশ হই না কেনৃ।’
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। নতুন সরকার গঠনের ছয় মাসের মধ্যে প্রথম দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যান তিনি, দ্বিতীয়টি হতে যাচ্ছে চীনে। এই দুই সফরের সময়ের ব্যবধান মাত্র দুই সপ্তাহের মতো। সরকারের শুরুর দিকে কাছাকাছি সময়ে আঞ্চলিক উদীয়মান দেশ দুটিতে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ‘ভারসাম্যের কূটনীতি’ হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
কাছাকাছি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরে ভারসাম্যের কূটনীতিতে নির্ভারতার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে, বাংলাদেশের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ। সব বিবেচনায় তাদের গুরুত্ব একটু বেশি। সমতার ভিত্তিতে আমরা এমন সম্পর্ক চাই, যাতে দুই দেশই উপকৃত হয়। চীনের সঙ্গেও আমরা সুসম্পর্ক রেখে এগোতে চাই। তারাও আমাদের উন্নয়নের সহযোগী।
গত ৯ জুন ভারতের টানা তৃতীয়বার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইমাসে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ২১-২২ জুন তিনি আবারও দেশটি সফর করেন। এ সফরে দুই দেশের মধ্যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি নতুন ও তিনটি নবায়ন করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি ও সমঝোতায় দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যু থাকলেও তার মূলে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলছেন, ঢাকা-দিল্লির আগামী দিনের সম্পর্ক কেমন হবে, তা স্পষ্ট হয়েছে এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরে।
এ সফর নিয়ে মঙ্গলবার (২৫ জুন) গণভবনে করা সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সফরে ভারতের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল নব-নির্বাচিত দুটি সরকার কীভাবে সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে একটি রূপকল্প প্রণয়ন। এ সফর ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আমি মনে করি, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এ সফর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘যেহেতু নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথ-চলা শুরু করেছে, সে ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর ‘স্মার্ট-বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি।’’
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৯-১২ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। ওই সফরে দুপক্ষের মধ্যে আট থেকে ১০টি সমঝোতা স্মারক নিয়ে কাজ হচ্ছে, যার মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি সই হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরের মূল ফোকাস হবে বাণিজ্য ও অর্থনীতি। একদিকে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং অন্যদিকে সাময়িক যে সহায়তাগুলো দরকার, সেটির বিষয়ে একমত হওয়া।
মঙ্গলবারের (২৫ জুন) সংবাদ সম্মেলনে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার দেওয়া ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি মেনে চলে যাচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছি। কখনও প্রশ্ন আসেনি কোথায় ব্যালেন্স কম হলো? এটা আসেনি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার যে সুযোগটা দিচ্ছে, সেটা হচ্ছে উন্নয়ন করার সুযোগ দিচ্ছে। আমার কাছে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের মানুষের কল্যাণে, দেশের উন্নয়নে কার সঙ্গে কতটুকু বন্ধুত্ব দরকার সেটা করে যাচ্ছি। ভারত আমাদের চরম দুঃসময়ের বন্ধু। আবার চীন যেভাবে নিজেদের উন্নত করেছে, সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সেগুলো সামনে রেখে সম্পর্ক বজায় রেখে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, কেউ মনে করলো— এদিকে ঝুঁকলাম নাকি ওদিকে ঝুঁকলাম; এই ঝোঁকা-ঝুঁকির ব্যাপার আমার নেই। আমার কিন্তু সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নেই। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, এমনকি বিদেশেও অনেকেই বলে— আপনি কীভাবে ব্যালেন্স করেন? আমি বলি— ব্যালেন্স কোনও কথা না। তাদের দুই দেশের (ভারত ও চীন) মধ্যে কী সম্পর্ক, সেটা তাদের ব্যাপার। আমি সেখানে নাক গলাই না। আমি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ভারতের সঙ্গে ১০টা এমওইউ, সমঝোতা স্মারক সই ও রিনিউ করলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করা দেশ। অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক অনেক ভালো। চীনও বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বেইজিংয়ের সঙ্গেও ঢাকার সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো পর্যায়ে রয়েছে। উভয় দেশের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ সরকার সুসম্পর্ক রেখে চলছে। প্রধানমন্ত্রীর সফর এই সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে। সে কারণে এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছি আমরা।
বাহাউদ্দিন নাছিমের মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর দেখানো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি অনুসরণ করছে আওয়ামী লীগ সরকার। টানা চার মেয়াদে এই নীতির কারণে এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের উন্নয়ন বেগবান হয়েছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে। সূত্র- বাংল ট্রিবিউন।