দেশ জুড়ে:
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে ১৮ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা হয়েছে। প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের কাছে চলতি হিসাবের ঘাটতির তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো হলো– ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ন্যাশনাল, ইউনিয়ন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কমার্স, পদ্মা ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বেশ আগে থেকে সাতটি ব্যাংক ঘাটতি নিয়ে চললেও নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে পদ্মা এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন কারণে আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাংক খাত নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। টাকা তোলার চাপ তৈরি হওয়ায় অনেকেই এখন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে চাহিদা মতো পাচ্ছেন না। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। আমানতকারীদের একটি অংশ টাকা তুলে নিজের কাছে রাখছে। আবার কেউ কেউ দুর্বল ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এমন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকে রাখছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামলাতে কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টি দিলেও এসব ব্যাংকে অন্যরা ধার দিতে রাজি হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের সঙ্গে প্রতিটি ব্যাংকের একটি চলতি হিসাব থাকে। এ হিসাব থেকে ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নগদ তারল্য সংরক্ষণ হিসেবে সিআরআর এবং সরকারি সিকিউরিটিজ হিসেবে এসএলআর রাখতে হয়। আবার আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া পুনঃঅর্থায়নসহ যাবতীয় লেনদেন হয় এ হিসাব থেকে। সাধারণভাবে সিআরআর এবং এসএলআরে ঘাটতি হলেও চলতি হিসাবে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। তবে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ ছিল এমন ব্যাংকগুলোতে ঋণযোগ্য তহবিল শেষ হওয়ার পর সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিশেষ এ সুযোগ দেন। ২০২২ সালের শেষ দিকে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংকের চলতি হিসাব ঋণাত্মক করে লেনদেনের নতুন এ উপায় বের করা হয়। চলতি হিসাবে যে পরিমাণ ঘাটতি থাকে, তার মানে ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই পরিমাণ পাওনা রয়েছে। এ পরিস্থিতি ব্যাংকের তারল্য সংকট এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় সমস্যাসহ নানা দুর্বলতার কারণে তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস গত বছরের নভেম্বরে পাঁচটি ব্যাংককে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে যে, ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে চলতি হিসাবে ঘাটতি মেটাতে না পারলে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এর পর ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে বছরের শেষ কর্মদিবস গত ২৮ ডিসেম্বর কোনো জামানত উপকরণ ছাড়াই বিশেষ ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাঁচ ইসলামীসহ মোট ৯টি ব্যাংকে ওই দিন দেওয়া হয় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালের শেষ কর্মদিবসেও পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকে ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট’ হিসেবে ১৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেআইনিভাবে আর লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর আন্তঃব্যাংক লেনদেন বন্ধ আছে।
কোন ব্যাংকের কত ঘাটতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ২০৯ কোটি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ২ হাজার ২০২ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৩৮১ কোটি, পদ্মা ২৩৪ কোটি এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ৯৬ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
ঘাটতির বিষয়ে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন এ তথ্য প্রকাশ করল, তা বোধগম্য নয়। এমনিতেই তারা এখন আমানত ফেরত দিতে না পারার চাপে আছেন। চলতি হিসাবে ঘাটতির তথ্য প্রকাশের ফলে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বাড়বে। ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগের সঙ্গে কোনোভাবেই যা সংগতিপূর্ণ নয়।