টাঙ্গাইল প্রতিনিধি:
শিক্ষকতা পেশা ছেড়েও সফল কৃষকের খ্যাতি পেয়েছেন টাঙ্গাইলের মো. ছানোয়ার হোসেন (৫০)। কলা, আনারস, ভুট্টা, পেঁপে, ড্রাগন ফল ও পেয়ারাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির পর এবার কফি চাষেও সফল হয়েছেন তিনি। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১ টন কফি উৎপাদন করছেন কফি চাষি ছানোয়ার।
কফিসহ কমপক্ষে ১০ ধরনের ফলের চাষাবাদ হচ্ছে তার বাগানে। নিরাপদ ফল উৎপাদনে এলাকার মানুষের কাছে আদর্শ চাষিও এখন ছানোয়ার। অনেকেই গ্রামটিতে আসছেন তার কফি বাগান দেখাসহ চাষাবাদের পরামর্শ নিতে। শুধু আদর্শ চাষি হিসেবেই স্বীকৃতি পাননি ছানোয়ার, পেয়েছেন সফল কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি স্বর্ণপদক’।
পাশাপাশি জেলার মধুপুর গড়ের উঁচু ও লাল মাটিতে আনারস, কলা, পেঁপের মতো কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনাও দেখিয়েছেন তিনি। যার ধারাবাহিকতায় কফি চাষকে এ অঞ্চলের কৃষিতে নতুন ফসল হিসেবে যোগ করতে কাজ শুরু করেছে কৃষি বিভাগ। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এরই মধ্যে কাজুবাদাম এবং কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় কৃষি বিভাগও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ কফির চারা বিতরণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্নী।
সফল কৃষক মো. ছানোয়ার হোসেন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামের জামাল হোসেনের ছেলে। ১৯৮৮ সালে মধুপুরের চাপড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯০ সালে কালিহাতী কলেজ থেকে এইচএসসি আর ১৯৯২ সালে মধুপুর কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন মো. ছানোয়ার হোসেন। পরে ১৯৯৩-৯৮ সাল পর্যন্ত সিলেটের রেঙ্গাহাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক আর পরবর্তী ২ বছর জেলার ঘাটাইলের গারোবাজার সুনামগঞ্জ পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে গ্রামে শুরু করেন চাষাবাদ।
দেবদারু চারার মতো অনেকটাই দেখতে কফির চারা। কফির পাকা গুটিগুলো দেখতে টকটকে লাল ও কোনো কোনোটা কাঁচা হলুদের মতো। কাঁচাগুলো সবুজ। মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি প্রতিটি পরিপক্ব গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। কফির পাশাপাশি ২৮০টি ড্রাগন পিলার, ১৯টি সৌদি খেজুর, ৫০০ পেঁপে, ১ হাজার মাল্টা, ৫০০ লেবু, আনারস, ওষুধি, কলা, জাম্বুরা গাছে ভরপুর ছানোয়ার হোসেনের বাগান। বর্তমানে প্রায় ১৫ একর জমিতে চলছে তার চাষাবাদ।
জানা যায়, মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল থেকে গুটিতে পরিণত হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে গুটিগুলো পরিপক্ব হয়। লালচে হয়ে যাওয়া কফির ফল সংগ্রহ করে প্রথমে পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। এরপর লম্বা সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। একটু নরম হওয়ার পর কফির ওপরের চামড়া ছাড়িয়ে নিতে হয়। পরে গুটিগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। বাজারজাত ও কফিপান করার উপযোগী করতে মেশিনের মাধ্যমে গুড়া পাউডারের মতো করে নিতে হয়। আবার কফির বীজ থেকে চারা উৎপাদনও করা যায়। ফলন ভালো ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে হেক্টরপ্রতি ৭৫০ থেকে ১০০০ কেজি এবং বছরে গাছপ্রতি ৫ কেজি কফি পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া ফলন দেওয়া শুরু হলে গাছগুলো থেকে একটানা ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত কফি পাওয়া যায়।
মধুপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, কাজুবাদাম এবং কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত মধুপুরের ১২০ জন কৃষক ৩৫ হেক্টর জমিতে কফি চাষ শুরু করেছেন। চাষাবাদ বৃদ্ধিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ প্রথম পর্যায়ে ৫৩ জন কৃষকের মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার কফির চারা বিতরণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করাসহ জনপ্রতি ১৩৫টি করে মোট ৯৪৫টি কফি চারা দেওয়া হয়। কৃষি বিভাগ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কফির চারা বিতরণ করা হয়েছে।
বিশ্বে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও এ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফি চাষ শুরু হয়েছে। চাষ উপযোগী আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুকূল থাকায় মধুপুর পাহাড়ি এলাকায় উন্নতমানের এবং ঘ্রাণের কফি চাষের বিশেষ কার্যক্রম চলমান। রোবাস্টা জাতের কফি চাষে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ও টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের আবহাওয়া আর মাটি যথেষ্ট উপযোগী বলেও জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কফি চাষি ছানোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি জেলার রায়খালী থেকে ২০০ চারা সংগ্রহ করে উপজেলায় প্রথম কফি চাষ শুরু করি। চাষ শুরুর ২ বছর পর থেকেই কফি বিক্রি করতে পারছি। বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশ জমিতে কফির আবাদ রয়েছে। আমার বাগানে অ্যারাবিক ও রোবাস্টা জাতের কফি গাছ আছে। প্রতি বছর আমি গড়ে প্রায় ১ টন কফি বিক্রি করতে পারছি। এ ছাড়া কফির বীজ থেকে চারাও তৈরি করছি।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমার বাগানের ৫০০ কফি গাছে ফলন হচ্ছে। গত ৭ বছরে কফি বাগান বাবদ আমার ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। তবে এরই মধ্যে আমি প্রায় দ্বিগুণ টাকা আয় করতে পেরেছি। এভাবে টানা ২০ বছর আয় হবে বলে আশা করছি।’
ছানোয়ার জানান, প্রসাধনী কোম্পানির মাধ্যমে আমি প্রতি কেজি উৎপাদিত গ্রিন কফি ২ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করছি। উৎপাদিত কফির মধ্যে ১৮ প্রকারের স্বাদ ও গন্ধ আছে। বাজারজাত ও কফি পান করার উপযোগী করতে মেশিনের মাধ্যমে কফি বীজ গুঁড়া করে নিতে হয়। কফি প্রক্রিয়াজাত করার কাজটিই কঠিন। এ কারণে আমি কফি প্রক্রিয়াজাত করার মেশিন কিনেছি। কফিকে একটি বড় শিল্পে পরিণত করাই এখন আমার স্বপ্ন।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে উপজেলায় কফি চাষের কৃষক সংখ্যা ১২০ জন। আবাদ হচ্ছে ৩৫ হেক্টর জমিতে। উপজেলার কৃষক ছানোয়ার হোসেন ব্যক্তি উদ্যোগে কফি বিক্রি করলেও বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ জন কৃষকের ৭টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করাসহ জনপ্রতি ১৩৫টি করে মোট ৯৪৫টি কফির চারা দেওয়া হয়েছে।’