অনিয়ম তদারকিতে উদাসীন রাজউক

প্রকাশিত: ৯:৫৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২৪

# ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানছে না কেউই
# ইটের আঘাতে নিহত ব্যাংকারের মৃত্যুতে কেউ শনাক্ত হয়নি
# ১০ বছরে ১৫ হাজার প্রাণহানির বেশিরভাগই নির্মাণশ্রমিক
# ক্ষতিপূরণ পেতে নানামূখী সমস্যায় হতাহতের স্বজনরা

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে অত্যাধুনিক বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন নান্দনিক স্থাপনা। ইমারত নির্মানের বিধিমালা থাকলেও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানসহ কেউই তা মানছেন না। ভবনের নকশা অনুমোদন দিলেও তদারকি না করায় প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। আর এতে হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিএলএস’র তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১৪ হাজার ৩০৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন ৭৯৩ জন। আর হতাহতের একটি বড় অংশই নির্মণশ্রমিক। নির্মাণশ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবনের নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে নির্মাণযজ্ঞ দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ মরে মরুক…, তদারকিতে নেই রাজউক। অনিয়ম তদারকিতে তাদের ব্যাপক উদাসীনতা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা কেবল নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের স্বজনরা ক্ষতিপূরণ পেতেও নানামূখী সমস্যায় পড়ছেন। যদিও রাজউক বলছে, সংস্থাটি নকশা অনুমোদন দেওয়ার পর নিয়মিত তদারকি করছে। তবে দুর্ঘটনা রোধে কেবল রাজউকই নয়, সিটি কর্পোরেশনসহ নির্মাণযজ্ঞের সংশ্লিষ্ট সবাইকেই সচেতন হতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি সকালে চুয়াডাঙ্গা শহরের মুক্তিপাড়ায় নির্মাণাধীন একটি সাততলা ভবন থেকে পড়ে ইয়াসিন আলি (২৬) নামের এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুই শ্রমিক। এর আগে গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের পাশে একটি ভবনের ওপর থেকে কংক্রিটের খÐ মাথায় পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক দ্বীপান্বিতা বিশ্বাস দিপু। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করেও এখনো কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এর আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানার শহীদ মোস্তফা কামাল লাইনে বহুতল নির্মাণাধীন ভবনের পাঁচতলা থেকে প্রাণ হারান মো. দানু মিয়া। এ ঘটনায় মো. বাবুল ও বিষু নামে আরো দুই শ্রমিক আহত হন। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায় বহুতল ভবন থেকে পড়ে মো. কামরুল ইসলাম নামের এক নির্মাণশ্রমিক প্রাণ হারান। একইদিন বিকেলে নীলফামারীর সৈয়দপুরের ঢেলাপীর এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে মারা যান বেলাল নামে এক নির্মাণশ্রমিক। গত ১৫ নভেম্বর রাজধানীর কদমতলী মোহাম্মদবাগ এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছয়তলা থেকে পড়ে মো. শাহ আলম ফকির নামের এক নির্মাণ শ্রমিক প্রাণ হারান। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে নরসিংদীর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের পৌরসভা এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে পলাশ রায় নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি সকালে ল²ীপুরের রায়পুর থানার নতুনবাজারের খাজুরতলা এলাকায় প্রবাসী জিহাদের বাড়ির ছাদের সামনের অংশে রং করতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গলায় রড ঢুকে প্রাণ হারান নির্মাণ শ্রমিক মো. রানা। তিনি ছিলেন পৌরসভার মধুপুর গ্রামের বাহার উদ্দিনের ছেলে। তার স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে। ২০২১ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি রাজধানী ডেমরার কোনাপাড়ায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে ইট মাথায় পড়ে মারা যান গার্মেন্টকর্মী রুনা বেগম (২২)। পরের বছরের ৩০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে আরেকটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল হাফিজ কারেমী। এভাবে মাঝেমধ্যেই নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে ইট-পাথর পড়ে এবং তদারকির অভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ভবন থেকে নিচে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য নির্মাণশ্রমিক। এসব মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী কে জনমনে সেই প্রশ্ন উঠলেও তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।
হতাহত শ্রমিকদের স্বজনরা নিউজ পোস্টকে জানান, বিশে^র বিভিন্ন দেশের আদলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই অত্যাধুনিক বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। বেশিরভাগ ভবন বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানায় ভবন তৈরি হচ্ছে। ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি করা ভবনগুলোর চারপাশে টিনশেডের বাউন্ডারি দিয়ে রাজউকের বিধিসম্বলিত সাইনবোর্ড প্রবেশমুখে দিলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। কোনো শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেয় না সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, এসব দুর্ঘটনায় হতাহত হলেও রাজউকের পক্ষ থেকে বিধি অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়না। তবে থানা পুলিশ ও এলাকার গণমান্য ব্যক্তিরা সমঝোতা বৈঠকের মাধ্যমে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ তুলে তা নিষ্পত্তি করে দেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নির্মাণশ্রমিক ও অধিকাংশ পথচারিরাই গরিব মানুষ। ভিআইপি কেউ না হলে এসব দুর্ঘটনায় এমন মানুষ মারা গেলে তাদের কিছু যায় আসে না। বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ মরে মরুক…, তদারকিতে নেই রাজউক। এসব দুর্ঘটনায় কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির হলে তৎপর হয়ে ওঠে রাজউকসহ পুলিশ প্রশাসন।
বুয়েট’র পুরকৌশল (সিভিল) বিভাগের অধ্যাপক মো. বদরুজ্জামান নিউজ পোস্টকে বলেন, যে ভবন থেকে ইট পড়ে আর যিনি ভবনটি বানান, এটা তাদের দায়। কারণ কনস্ট্রাকশন সেফটি প্ল্যান অনেকে অনুসরণ করেন না। দেখা যায়, ১০ তলার ওপর একজন ওয়েল্ডিং করছেন কোমরে কোনোরকম একটি দড়ি বেঁধে নিয়ে। রাজউকের নিয়মিত এসব মনিটর করার কথা। থার্ড পার্টি হিসেবে তারা সেই কাজটিও ঠিকমতো করছে না। তিনি বলেন, নির্মাণাধীন ভবনের সরঞ্জাম পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায়ও আনা হচ্ছে না। যেন বাংলাদেশের মানুষের জীবনের দাম কম। গরিব মানুষ হলে তো কথাই নেই। সেফটি প্রটোকল অনুসরণ করলে দুর্ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও অনেকটা কমে আসবে বলে জানান তিনি।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের পর প্রতিটি পর্যায়ে কাজ তদারকির কথা। টিনশেড কাঠামো থেকে শুরু করে বহুতল ভবন নির্মাণ সবক্ষেত্রেই এ নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু রাজউকের পক্ষ থেকে কখনোই নির্মাণকাজ তদারকি করা হয় না। নির্মাণের শুরু থেকে একজন পরিদর্শক সার্বক্ষণিক তদারকি করার কথা থাকলেও নকশা অনুমোদন দিয়েই যেন তারা দায়িত্ব শেষ করেন। বিধিমালার ৩০৫ ও ৩০৭ ধারায় বলা হয়েছে, বহুতল ভবন নির্মাণ শুরুর সময় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাজউককে অবহিত করবে। রাজউকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কাজ শুরু হবে। বিধিমালার ৩১১ ধারায় বলা হয়েছে, বেজমেন্ট নির্মাণের পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে রাজউকের কাছ থেকে একটি সনদপত্র নিতে হবে। ৩১৩ ধারায় বলা হয়েছে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্ব পালন করলেও রাজউকের পক্ষ থেকে তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৪০২ ধারায় বলা হয়েছে, ভবনের নকশা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থপতি ও প্রকৌশলীরা তদারকি করবেন এবং প্রতিটি স্তরের কাজ শেষের পর রাজউককে অবহিত করে পরবর্তী স্তরের কাজের অনুমোদন নিতে হবে। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর রাজউক থেকে ভবনের ব্যবহার সনদপত্র নেওয়ার কথা বলা হয়েছে বিধিমালার ৪০৭ ধারায়। এই সনদপত্র জমা দেওয়ার পর সেখানে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দেবে সেবা সংস্থাগুলো। অথচ রাজউক কখনোই স্তরে স্তরে মনিটরিংয়ের কাজ করে না। আবার ভবন ব্যবহারের ছাড়পত্র না নিয়েও অনেকে সেবা সংযোগ পেয়ে যান।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান নিউজ পোস্টকে বলেন, রাজউকের ইন্সপেক্টর ও অথরাজইড অফিসাররা সরেজমিন পরিদর্শন করলে নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়টি বের হতো। মনে হয় তারা একবারও সরেজমিন যান না। তিনি বলেন, শ্রমিকদের হেলমেট ও নির্ধারিত ড্রেস ছাড়া কাজ করার সুযোগ নেই। অনেকখানে নিরাপত্তা জাল-শেড থাকে না। স্থানীয় কাউন্সিলররাও কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে জানায় না। সমন্বয়হীনতা আর তদারকির অভাবে প্রতিনিয়তই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ লেবার স্টাডিজের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১৪ হাজার ৩০৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন ৭৯৩ জন। আর হতাহতের একটি বড় অংশই নির্মণশ্রমিক।
সারা দেশের একটি জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা নিউজ পোস্টকে বলেন, ২০২৩ সালে সারাদেশে ৭১২টি দুর্ঘটনায় ৮৭৫ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে পরিবহন খাতে। এরপরই রয়েছে নির্মাণশ্রমিক। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাননি। তিনি বলেন, মালিক এবং সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর যথাযথ পরিদর্শনে অবহেলা এবং দায় এড়ানোর কারণেই দুর্ঘটনা ও হাতহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালনা বোর্ডের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী নিউজ পোস্টকে বলেন, নির্মাণভবনের চারপাশে শেড-নেট দিতে হয়। যাতে নির্মাণসামগ্রী পড়ে গেলে শেডে আটকে যায়। শ্রমিকদের কাজ করার সময় সেফটি বেল্ট পরার কথা থাকলেও তারা তা করেন না। কিন্তু অনেকেই এ নিয়মের ধার ধারেন না! এটা দেখার দায়িত্ব মূলত রাজউকের। তবে ভবন ব্যবহারের জন্য সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র লাগে। তাই তারাও নজরদারি বাড়াতে পারে। রাজউকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, মাথায় ইট পড়ে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনা নিতান্তই দুঃখজনক। ভবন মালিক এর দায় এড়াতে পারেন না। নির্মাণকাজ তদারকিতে রাজউক তৎপর রয়েছে। কোথাও অনিয়ম দেখা দিলে নোটিশ পাঠিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেককে আইনের আওতায় এনে জরিমানা করা হচ্ছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া, যা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান রাজউক কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দীন আহমদ।