অযত্নে নষ্ট হচ্ছে রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজগুলো 

প্রকাশিত: ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৪

আফরিন আক্তারঃ

রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোর বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে ফুটওভার ব্রিজ। পথচারীদের আকৃষ্ট করতে এসব ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি বাজেটে ও আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন করে। এমনকি ফুট ওভারব্রিজে থাকছে চলন্ত সিঁড়ির মতো সুবিধাও। নিরাপদে সড়ক পারাপারের জন্য নির্মিত এসব ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

তবে এই নির্মাণেই যেন দায় শেষ কর্তৃপক্ষের। পরবর্তী সময়ে সেই ফুটওভার ব্রিজগুলোতে থাকে না কোনও তদারকি। ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়েই অনেকেই বিপজ্জনকভাবে সড়ক পার হলেও দেখার কেউ নেই। এমনকি ব্রিজগুলোকেও নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। এতে সেগুলোর মেয়াদ ফুরোনোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়। আবার কোনও কোনও ব্রিজ পরিণত হয় ময়লার স্তূপ ও ছিন্নমূল মানুষের আবাসস্থলে।

সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটওভার ব্রিজ ঘুরে দেখা যায়, নতুন-পুরাতন সব ফুটওভার ব্রিজের বিভিন্ন কোনায় জমে আছে ময়লা। যে কয়েকটি চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ আছে, সেগুলোর অধিকাংশেই চলন্ত সিঁড়ি অচল। সিঁড়ি জুড়ে ময়লা কাগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। চলন্ত সিঁড়ির গায়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রচারণার পোস্টার। দীর্ঘ সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ না করায় ফুট ওভারব্রিজগুলোর এই দশা বলে মনে করেন পথচারীরা।

এদিকে সকালে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সড়ক পরিষ্কার করতে দেখা গেলেও ওপরের ফুটওভার ব্রিজগুলো অপরিচ্ছন্ন রেখে দেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানান, সড়কের পাশাপাশি ফুটওভার ব্রিজ পরিষ্কার করতে হবে এমন কোনও নির্দেশনা তাদের দেওয়া নেই। তাছাড়া সাধারণ ঝাড়ু ছাড়া ওভারব্রিজ পরিষ্কারের জন্য তেমন বিশেষ কিছু দেওয়া হয় না তাদের।

রাজধানীর ইসিবির চত্বরে কাছে বছরখানেক আগে উদ্বোধন করা হয় একটি ফুটওভার ব্রিজ। গত ২৭ এপ্রিল ওভারব্রিজটি ঘুরে দেখা যায়, ব্রিজটি ইতোমধ্যে নানা পোস্টারে ছেয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে চলন্ত সিঁড়িও। সাধারণ ও চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার মুখেও পড়ে আছে নানা ধরনের কাগজ। ব্রিজের বিভিন্ন অংশে জমে আছে ময়লার স্তূপ।

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বনানী ও এয়ারপোর্টের চলন্ত সিঁড়ির ফুটওভার ব্রিজ দুটির অবস্থা আরও খারাপ। এর বাইরে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় সাধারণ যেসব ব্রিজ আছে, তার অধিকাংশই দীর্ঘদিন দেখভালের অভাবে প্রায় ভঙ্গুর অবস্থা। অনেকগুলোর ওঠার সিঁড়ি ক্ষয় হয়ে গেছে। চলাচলের অংশে দেখা গেছে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পান্থপথের পানি ভবনে সামনে, মিরপুর ১০ ও ১ নম্বরে এবং শাহবাগ ফুল মার্কেটের সামনেসহ বেশ কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ ঘুরেও এমন চিত্র দেখা গেছে। এছাড়া গাবতলী আন্ডারপাসটিও প্রায় অন্ধকার, ময়লার দুর্গন্ধ ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় দেখা গেছে।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কেন ফুটওভার ব্রিজ নিয়মিত পরিষ্কার করেন না, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এক সুপারভাইজার বলেন, ‘প্রত্যেক কর্মীকেই রাস্তা-ফুটপাতসহ ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ি পরিষ্কার করার কথা বলা আছে। তারা সাধারণ ঝাড়ু নিয়ে যায়। যদি কোথাও বেশি ময়লা থাকে তা পরিষ্কারের জন্য আরও জিনিসপত্র যদি লাগে তারা জানালেই আমরা সেগুলো দেই।’

ফুটওভার ব্রিজের সুরক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্র্যাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) মো. রফিকুল ইসলামকে ফোন দিলে তিনি ‘মিটিংয়ে আছেন’ বলে ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি। তার অফিসে গিয়েও এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

তবে এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী (পুর) মো. লুৎফর কবির বলেন, আমাদের এখান থেকে নতুন করে ফুটওভারব্রিজ তৈরি করা হয়। কিন্তু দেখভালের যে বিষয় সেটি সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিস দেখে। আমাদের মোট ১০টা (উত্তরে ১০ ও দক্ষিণে ১০) জোন আছে। যেটা যেই জোনের আওতায় পড়েছে সেটা ওই জোন মেইনটেইন করে।

নগরভবন সূত্রে বলা হয়, পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে বিভিন্ন আউউসোর্সিং প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। সেসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারলে এই পরিচ্ছন্নাজনিত সমস্যা সূর হবে।উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ফুটওভার ব্রিজ দেখভালের দায়িত্ব যে আঞ্চলিক অফিসের ওপর থাকে, সেই কার্যালয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ গাড়ি রাখা থাকে। বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে এসব কাজ দেখভাল করা হয়।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ফুটওভার ব্রিজ আর সড়ক পরিষ্কারকে একভাবে দেখলে হবে না। নিয়মিত ঝাড়ু দিয়ে সড়ক পরিষ্কার করা যায়, কিন্তু ফুটওভার ব্রিজ একটি বিশেষ স্থাপনা। এটি পরিষ্কারের জন্য নানা জিনিসপত্র প্রয়োজন।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের ফুটওভার ব্রিজে এমনিতেই নাগরিকরা উঠতে চান না। সেখানে ফুটওভার ব্রিজের বেহালদশা দেখলে তারা আরও নিরুৎসাহী হবেন। আমাদের নাগরিক ব্যবস্থায় যেসব জায়গায় নজরদারি করা উচিত, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা লক্ষণীয়।’

তিনি বলেন, ‘ফুটওভার ব্রিজ আকর্ষণীয় করতে নানা ডিজাইন করা হয়, গাছ লাগানো হয়, এক্সেলেটর সিঁড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর গাছগুলো মরে যায়, নোংরা হয়ে চলাচলের ভোগান্তি বাড়ে। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া ফুটওভার ব্রিজগুলো বিশেষভাবে পরিষ্কার রাখার জন্য। সাধারণ ঝাড়ুতে এটি পুরোপুরি পরিষ্কার সম্ভব না। তাদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়া এই বিষয়ে। এছাড়া ব্রিজগুলো রং করে রাখা এবং কর্তৃপক্ষের উচিত ফুটওভার ব্রিজ যেন কেবল নাগরিকদের সুন্দরভাবে চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করা।’