আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেন নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রধান ‘মাহমুদ’

প্রকাশিত: ৭:১৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
আত্মগোপনে থাকা সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেছেন নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র প্রধান আমির মাহমুদ। শুধু তাই নয়, পাহাড়ে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। পরবর্তীতে ২০২১ সালে কেএনএফের ছত্রছায়ায় বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে চুক্তিও সম্পাদন হয় তাদের মধ্যে। নিজেদের গড়া নতু এ জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্বের জানান দিতে  সুযোগ বুঝে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর একের পর এক হামলা চালানোর অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন জঙ্গি নেতা আমির মাহমুদ ও তার অনুসারীরা। মূলত জঙ্গি নেতা আমির মাহমুদের মূল টার্গেট ছিল তিনি ও তার অনুসারিদের নিয়ে নিজেদের মত করে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামের জঙ্গি সংগঠনকে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলা। নানান তথ্যের ভিত্তিতে তাকে ধরতে গেলেই আত্মগোপনে চলে যেতেন নতুন জঙ্গি সংগঠনের আমির (প্রধান নেতা) মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। স্থান পরিবর্তন করে বার বার আত্মগোপনে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি জঙ্গি নেতা মাহমুদের। আজ সোমবার (২৪ জুলাই) দুপুরে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে যে, আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ সংগঠনের কয়েকজন সদস্যসহ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকায় একটি বাড়িতে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে আজ রোববার (২৩ জুলাই) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ওই বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব-১০ এর একটি দল। এসময় সেখান থেকে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান (আমির) আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ ও তার দুই সহযোগী কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ (৩৪) ও মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি (২৮)। তখন তাদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদী বই ও নগদ অর্থ উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে সিএনজি পাম্পে চাকরি করেন। এরপর কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করেন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। বর্তমানে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের আমির তিনি। র‌্যাব বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানাতে চেয়েছিলেন আমির মাহমুদ।

র‌্যাব জানায়,  দেশের বাইরে হামলার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও দেশের মধ্যে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তাদের টার্গেট ছিল কিলিং মিশন। আর তাদের আইনের আওতায় আনতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছিলেন আমির মাহমুদ।

র‌্যাব আরও জানায়, গ্রেফতার আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের একটি সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। এর আগে হুজির সদস্য ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে আনসার আল ইসলামের রক্সি ও ফেলানীর সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর তারা যাত্রাবাড়ীতে মিটিং করে নতুন একটি সংগঠন তৈরি ও বিস্তারের পরিকল্পনা করে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কার্যক্রম শুরু করেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। ২০১৬ সাল বিভিন্ন সময় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের পক্ষে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি। ২০২০ সালে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বান্দরবানের গহীন এলাকায় যান তিনি। বান্দরবানে আসলাম নামক এক ব্যক্তির কাছে প্রায় এক মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালনা ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। আমির মাহমুদ কুমিল্লার প্রতাপপুরে বাড়িসহ তার জমিটি ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। জমি বিক্রির কিছু টাকা সংগঠনে দেন। বাকি টাকা দিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে তিন বিঘা জমি কিনে ওই বছরই সেখানে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন আমির মাহমুদ। সেখানে তিনি পোল্ট্রি ফার্ম, চাষাবাদ ও গবাদিপশুর খামার পরিচালনা করতেন।

র‌্যাব জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ র‌্যাবকে জানিয়েছেন- আগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালে রক্সি গ্রেফতার হলে সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের সিদ্ধান্তে মাহমুদকে আমির করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের সময় মাহমুদের সঙ্গে কেএনএফ সদস্যদের পরিচয় হয় এবং কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। পরবর্তীতে ২০২১ সালে কেএনএফের ছত্রছায়ায় বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে চুক্তি হয় তাদের মধ্যে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেবে কেএনএফ। এজন্য প্রতিমাসে কেএনএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও খাবার খরচ বাবদ ৩-৪ লাখ টাকা দিতেন আমির মাহমুদ। এই অর্থ দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হতো। এছাড়া আমির মাহমুদের নির্দেশনায় কেএনএফ থেকে ১৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের ভারি অস্ত্র ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র কেনা হয়, যা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আমির মাহমুদের নির্দেশনায় কেএনএফ প্রধান নাথান বমকে রাজধানীর বাসাবোতে সংগঠনের অর্থায়নে একটি বাসাভাড়া করে দেওয়া হয়। যেখানে নাথাম বম পরিবারসহ মাঝে মধ্যে অবস্থান করতেন। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ৮ মাস বাসাবোর ওই ভাড়া বাসায় অবস্থান করেন পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথান লনচেও বম।

র‌্যাব আরও জানায়, কেউ যদি প্রশিক্ষণ নিতে অসম্মতি জানাতেন বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন তাহলে তাকে জঙ্গি সংগঠনের বানানো জেলখানায় বন্দি করে রাখা হতো। এছাড়া কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বা বিদ্রোহ করলে তাকে গুলি করে হত্যার ঘোষণা দেন জঙ্গি নেতা  মাহমুদ।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি মেজর জিয়ার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে একটি মিটিংয়ে আমির মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী আনসার আল ইসলাম আমির মাহমুদকে ১৫ লাখ টাকা দেয়। এজন্য জামাতুল আনসারের সদস্যদের আনসার আল ইসলাম আইটি ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে। বিনিময়ে আনসার আল ইসলামের সদস্যদের জামাতুল আনসার পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করবে। এ বিষয়ে মাহমুদ কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে অবহিত করেন ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় করেন।

র‌্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর অভিযান শুরু হলে আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ পাহাড় থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন। সংগঠনকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য পলায়নকৃত ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন জঙ্গি নেতা মাহমুদ। তিনি বলেন, কেএনএফ প্রধান নাথান বম পার্শ্ববর্তী দেশের মিজোরামে অবস্থান করছেন। বিভিন্ন সময়ে কেএনএফের হামলা ও আক্রমণের বিষয়ে আমির মাহমুদের ইন্ধন থাকতে পারে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) যোগাযোগ খতিয়ে দেখছে র‌্যাব। কেএনএফের ভেরিফায়েড পেজে নুরকে নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সামনে এসেছে। ভিপি নুরের সঙ্গে কেএনএফের যোগাযোগ রয়েছে কি না বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দারা কাজ করছে।
কমান্ডার মঈন আরও বলেন, সূ²ভাবে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ গোয়েন্দারা করছে। কেএনএফের সঙ্গে নুরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে এ বিষয়ে পরে বলা যাবে। বাহ্যিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কেএনফের ভেরিফায়েড পেজে যেহেতু এ বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে যোগাযোগ থাকতেই পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল হক নুর বলেন, এগুলো একবারে আজগুবি কথাবার্তা। এ ধরনের কোনো যোগাযোগ আমার নাই। এসব একেবারে অসত্য, উদ্ভট ও বানোয়াট।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি সিলেটের জগন্নাথপুরে একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৮ সালে গ্রেফতার রনবীরের মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করেন ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন মাহফুজুর। তিনি সিলেট অঞ্চলে দাওয়াতি শাখার আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন। সিলেট অঞ্চলের যোগদান করা সদস্যদের ভুল বুঝিয়ে তথাকথিত জিহাদ ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ স্থানীয় একটি পলিটেকনিক্যাল ইনসটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষে পটুয়াখালীতে ব্যবসা করতেন। তিনি ২০০৪ সালে জঙ্গি সংগঠন হুজিতে যোগ দেন। হুজির কার্যক্রম স্তিমিত দেখে ২০১৪ সালে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে গ্রেফতার শাওনের মাধ্যমে জামাতুল আনসারে যোগ দেন কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ। তিনি মূলত ইলেকট্রিক্যাল কাজ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শীদের বাছাই করে সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িতদের ধরতে সম্ভাব্যস্থানে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।