আদালতের নিরাপত্তায় ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ গঠনের আবেদন
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টসহ অধস্তন আদালতসমূহে নিরাপত্তা বিধান ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষায় সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ গঠনের আবেদন করা হয়েছে। আজ রোববার (১২ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বরাবর এ আবেদন জানান। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে এ আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
আবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সংবিধানের মূলনীতি অনুসারে রাষ্ট্রের মৌলিক অংশ তিনটি যথা আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এর মধ্যে আইন বিভাগ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, কারণ আইন বিভাগের সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।
অপরদিকে, শাসন বিভাগ আংশিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, কারণ শাসন বিভাগের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীসহ প্রায় সবাই আইন বিভাগের সদস্য। কিন্তু বিচার বিভাগের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিচার বিভাগের একমাত্র প্রধান কাজ হচ্ছে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের মৌলিক বাহিনী হচ্ছে ‘পুলিশ’। কিন্তু শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা তাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের ওপর আস্থাশীল নন। তাই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী- এসব ভিআইপির নিরাপত্তার জন্য গঠিত হয়েছে ‘স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেস’।
সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালতসমূহের নিরাপত্তা বিধান করে পুলিশ ও পুলিশের বিভিন্ন শাখা। পুলিশ যেহেতু শাসন বিভাগের মৌলিক বাহিনী তাই পুলিশকে তাদের কাজের ক্ষেত্রে অ্যাকশন ও ইনঅ্যাকশন এর ব্যাপারে শাসন বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালতসমূহের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। কিন্তু যেহেতু তারা শাসন বিভাগের মৌলিক বাইনী তাই শাসন বিভাগের নির্দেশনা ছাড়া তাদের পক্ষে কোনোকিছু করা সম্ভব নয়।
পুলিশ যেহেতু শাসন বিভাগের মৌলিক বাহিনী তাই সব ক্ষেত্রে অ্যাকশন ও ইনঅ্যাকশন এর ব্যাপারে পুলিশকে শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে দেশের বিভিন্ন আদালতের আইনজীবী সমিতিগুলোতে সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় আইনজীবীদের মধ্যে সংঘাতে পুলিশ কোনো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে না। এর ফলে আইনজীবী সমিতিগুলোতে সংঘাত ও সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে এবং আদালত অবমাননার ঘটনা ঘটে।
‘পুলিশ’ যেহেতু শাসন বিভাগের মৌলিক বাহিনী এবং পুলিশকে শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুসারে চলতে হয়, তাই পুলিশের ওপর বিচার বিভাগের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ গত ২৮ অক্টোবর কিছু দুর্বৃত্ত প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও বিচারপতিদের বাসস্থান জাজের কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বারে ব্যাপক হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের ইনঅ্যাকশন ভূমিকার কারণে পুলিশ তেমন কোনো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এমতাবস্থায় প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতিদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ থাকবেই কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগকে সব ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত ও সংঘর্ষ থেকে নিরাপদ রাখতে হবে। প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের জীবন কখনই রাজনীতির বিষয়বস্তু হতে পারে না। এমতাবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতসমূহের নিরাপত্তার জন্য এবং বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিরাপত্তা বিধানে সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ গঠন করা আবশ্যক।
এই ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ এর প্রধান কার্যালয় হবে সুপ্রিম কোর্টে এবং এর প্রধান হবেন একজন ডিরেক্টর জেনারেল। উক্ত ডিরেক্টর জেনারেল তার সব কাজের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। এছাড়া প্রতিটি জেলার আদালতে ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ এর দায়িত্বে থাকবেন একজন অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল, যিনি উক্ত জেলা আদালতের দায়রা জজের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবেন। আদালত অঙ্গনের নিরাপত্তার পাশাপাশি বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন এই ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ এর সদস্যরা। এক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনে শাসন বিভাগের অন্যান্য বাহিনী এই ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ এর সঙ্গে তথ্য আদান প্রদান ও সমন্বয় করতে পারবেন। সাধারণভাবে এই ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ গঠন করতে আইন বিভাগ কর্তৃক পৃথক আইন পাশ করা আবশ্যক। কিন্তু এই নির্বাচনকালীন সময়ে এবং রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের কারণে আইন বিভাগ এই ধরনের বিল উত্থাপন করতে আগ্রহী হবে না। তাই আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ‘সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস’ সংশোধনের মাধ্যমে এই বাহিনী গঠন করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে ‘সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস’ এর অধীনে এই বাহিনী পরিচালিত হবে। তবে ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিবে বাজেট নিয়ে। এক্ষেত্রে আইন বিভাগ যথাযথ বাজেট বরাদ্দ না দিলে সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে শাসন বিভাগ থেকে স্বাধীন থাকবে। এ স্বাধীনতা বলতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও বোঝাবে। এক্ষেত্রে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের সব ধরনের কোর্ট ফির টাকা বিচার বিভাগের অ্যাকাউন্টে জমা হবে। বিচার প্রার্থীদের প্রদত্ত কোর্ট ফি কখনোই রাষ্ট্রের রাজস্বের অংশ হতে পারে না। শাসন বিভাগ শুধুমাত্র ভ্যাট দাবি করতে পারে কিন্তু সব থরনের কোর্ট ফি’র টাকা বিচার বিভাগের অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
বর্তমান এই রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বড় আকারে সম্ভব না হলেও ছোট আকারে ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ গঠন করা অত্যাবশ্যক। তা না হলে রাজনীতিবিদরা বিচারপতি ও নিন্ন আদালতের বিচারকদের জীবন নিয়ে রাজনীতি করতে দ্বিধা বোধ করবে না। এক্ষেত্রে সাময়িকভাবে সামরিক বাহিনী ও সরকারের অন্যান্য বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিয়ে ‘জুডিসিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সেস’ গঠন করা যেতে পারে।
সামরিক বাহিনী সদস্যরা উন্নতমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অতি অল্প বয়সে অবসরে যান। তাই তারা বিচার বিভাগের নিরাপত্তা রক্ষায় এবং বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিরাপত্তা রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। পাশাপাশি আইনজীবী সমিতিগুলোও সংঘাত ও সংঘর্ষ থেকে রক্ষা পাবে বলেও আবেদনে উল্লেখ করা হয়।