‘আমাদের লক্ষ্য উৎকৃষ্ট ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করে দেশসেরা ব্যাংক হওয়া’

নিজেস্ব প্রতিবেদক:
*বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যাগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন? এ সমস্যাগুলো কীভাবে কমিয়ে আনা যায়?
– সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন: আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বেশকিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সুশাসনের অভাব, অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ, পরিপালন নীতি পালনে অনীহা, তারল্যসংকট, ত্রুটিপূর্ণ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক, রাজনৈতিক প্রভাব, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে পিছিয়ে থাকার মতো বিষয়গুলো। এই চ্যালেঞ্জগুলো পুরোপুরিভাবে দূর করা সম্ভব না হলেও এগুলো অনেকাংশে কমিয়ে এনে ব্যাংকিং খাতকে গতিশীল করা সম্ভব। এর জন্য নিতে হবে কিছু কার্যকরী উদ্যোগ।
করপোরেট সুশাসনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া, পরিপূর্ণভাবে গ্রাহক যাচাইয়ের পর ঋণ অনুমোদন দেওয়া, রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলার পাশাপাশি গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু ব্যাংকের প্রধান সম্পদই হচ্ছে মানুষের আস্থা, তাই মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে আমাদের তৎপর হতে হবে। এই বিষয়গুলো ব্যাংকিং খাতে বাস্তবায়ন করা গেলে সমস্যা কাটিয়ে উঠে আমরা ধীরে ধীরে উন্নতির পথে যাব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
* বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমস্যা সমাধানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
– সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন: আমাদের দেশে টেকসই ও শক্তিশালী ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত তৈরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় দায়িত্ব আছে। ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশিকা থাকার পরও বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি অনেক ব্যাংকই রাজনৈতিক প্রভাবের আশ্রয় নিয়ে এসব নীতিমালা অগ্রাহ্য করে গেছে। ফলে, আর্থিক খাতে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন খেলাপি ঋণ হয়েছে লাগামহীন। তবে, আশার কথা হলো, এই বিশৃঙ্খলা এখন থেমেছে। উন্নতির পথে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত।
অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনতে পারে। যে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন এবং আর্থিক খাত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই খাত-সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ঝুঁকিব্যবস্থাপনা ও পরিপালন নীতিগুলো বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সংস্করণ করা যেতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশ ব্যাংক এমন একটি ব্যাংকিং ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারে, যা গ্রাহকদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সীমা লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাৎক্ষণিক জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে ভূমিকা রাখবে। দেশের মানুষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে শিল্পায়নের লক্ষ্যে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো এবং দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত ও টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎমুখী নীতি গ্রহণের মতো পদক্ষেপগুলি প্রত্যাশা করে।
* চলমান সংস্কার কর্মসূচি আপনার ব্যাংকে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
– সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন: ব্যাংকিং খাত সংস্কারে অন্তর্র্বতী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবিদার। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে আমরা গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসতে লক্ষ করছি। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে, সার্বিক সংস্কার বাস্তবায়ন হলে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
চলমান সংস্কার কর্মসূচি আমাদের ব্যাংকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সুশাসন হলো ব্র্যাক ব্যাংকের মূল্যবোধের অংশ। আমাদের ব্যাংকে আমরা সব সময়ই আমাদের অভিজ্ঞ পরিচালনা পর্ষদ এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিমের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করে থাকি, যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় গ্রাহকদের স্বার্থকে। গ্রাহক আস্থা অর্জনে আমরা এগিয়ে আছি। ফলে, আমাদের কোনো তারল্যসংকট নেই। আমাদের খেলাপি ঋণের হার ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাভারেজের চেয়ে অনেক কম। আমানত ও ঋণ পোর্টফোলিওতে আমরা বজায় রেখেছি আনুপাতিক বৈচিত্র্য, যা আমাদেরকে শক্তিশালী অবস্থান বজায় রাখতে সহায়তা করছে। ব্যাংকিং সংস্কারে নেওয়া উদ্যোগগুলো দেশের সব ব্যাংকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন ও অনুশীলন করা গেলে আমরা অচিরেই আমাদের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।
* আপনার ব্যাংকের সুশাসন সংস্কৃতি, ব্যবস্থাপনা মানদণ্ড ও সক্ষমতা নিয়ে কিছু বলুন।
– সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন: ব্যাংকিংয়ের সব স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সূচকে ব্র্যাক ব্যাংক ভালো করছে। এর জন্য আমি আমাদের গ্রাহক ও সহকর্মীদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। ব্র্যাক ব্যাংকে আমাদের লক্ষ্য হলো, গ্রাহকদের জন্য উৎকৃষ্ট ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশসেরা ব্যাংক হওয়া। এ লক্ষ্যে আমরা ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গেছি। করপোরেট সুশাসন এবং রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্সের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা কৌশল প্রণয়ন করি, যার ফলে সব ক্ষেত্রে আমরা ধারাবাহিক সাফল্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি।
সবচেয়ে বেশি মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ও ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ারহোল্ডিং এবং আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা- এসঅ্যান্ডপি ও মুডিজ থেকে প্রাপ্ত দেশের সব ব্যাংক থেকে উৎকৃষ্ট ক্রেডিট রেটিং ব্র্যাক ব্যাংকের উচ্চমানের ব্যবস্থাপনা ও কর্মদক্ষতার প্রতিফলন বহন করে। প্রায় সব আর্থিক সূচক ও মানদণ্ডে ব্র্যাক ব্যাংক অন্য সব লোকাল ব্যাংক থেকে এগিয়ে আছে। এছাড়াও সুশাসন ও মূল্যবোধভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশের আর্থিক খাতে অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দৃঢ় ও মজবুত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমাদের আর্থিক এবং ব্যাবসায়িক সক্ষমতা আমাদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। উদ্ভাবনী প্রোডাক্ট ও সার্ভিস এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং সক্ষমতা নতুন নতুন গ্রাহক সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। ব্র্যাক ব্যাংক এখন মানুষের প্রথম পছন্দের ব্যাংক। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। এর পেছনে রয়েছে আমাদের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, পর্যাপ্ত তারল্য, ন্যূনতম খেলাপি ঋণ এবং মুডিস ও এসঅ্যান্ডপি-এর মতো বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি থেকে পাওয়া দেশসেরা ক্রেডিট রেটিং। গ্রাহকরা তাদের অর্থের নিরাপদ ও সুরক্ষিত ক্ষেত্র হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংককে রেখেছে পছন্দের শীর্ষে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ ১০ টেকসই ব্যাংকের মধ্যে আমরা একটি। আমাদের পরিচালনা পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতেই সর্বোচ্চ। সামাজিক ও পরিবেশগত খাতে আমাদের সিএসআর কার্যক্রম রেখে চলেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে দেশব্যাপী আমাদের ব্যাংকের নেওয়া নানান উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। গ্রাহকদের জন্য সর্বোচ্চ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিতে আমরা আমাদের সহকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমরা প্রতিষ্ঠানে এমন এক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেছি, যা সহকর্মীদের সব সময় প্রফুল্ল রাখে। এটির ইতিবাচক প্রভাব আমরা গ্রাহকদের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই। এ সবকিছুই আমাদের দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিচ্ছে।
আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও মূল্যবোধভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রমের লালিত স্বপ্ন ধারণ ও পালন করে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।