
সেলিনা আক্তার:
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ ব্যাংক উদ্যোক্তা ও নির্বাহীদের
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় তদারকি সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। এসব সংস্কার কার্যক্রমকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তা এবং শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, যে কোনো সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করার আগে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কারণ এসব সংস্কার কার্যক্রম তারাই বাস্তবায়ন করবেন। সংশ্লিষ্ট খাতে নীতিমালা বা পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কথাগুলো শোনা জরুরি বলে মনে করছেন তারা। আবার কেউ কেউ ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করার কথাও বলেছেন।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের বাণিজ্যিক খাতের বেশকিছু ব্যাংক নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সুশাসনের অভাব, অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ, পরিপালন নীতি পালনে অনীহা, তারল্য সংকট, ত্রুটিপূর্ণ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক, রাজনৈতিক প্রভাব, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে পিছিয়ে থাকা ইত্যাদি। বিশ্লেষদের মতে, চ্যালেঞ্জগুলো পুরোপুরিভাবে দূর করা সম্ভব না হলেও এগুলো অনেকাংশে কমিয়ে এনে ব্যাংকিং খাতকে গতিশীল করা সম্ভব। এর জন্য নিতে হবে কিছু কার্যকরী উদ্যোগ। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক (বিএবি) এর চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার ইত্তেফাককে বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ বা নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হোক। কারণ আমরা তো স্টেকহোল্ডার, দিনশেষে আমাদেরকেই এসব নীতির বাস্তবায়ন করতে হবে। সবাইকে ডাকা সম্ভব না হলেও যারা এ খাতটি রিপ্রেজেন্ট করেন তাদেরকে ডাকা যায়। তাহলে আমাদের কোনো অভিযোগ থাকে না। তিনি বলেন, দেখা গেল আমাদের যুক্ত না করে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো যা বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য কষ্টকর। সেজন্য যে কোনো নীতিমালা বা পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের কথাগুলো শোনা জরুরি বলে মনে করি।
বেসরকারি খাতের শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখানে চেয়ারম্যান, পরিচালক নিয়োগ করে তারা। এসব ব্যাংক যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে না আসে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আসবে না। তার মতে, আর্থিক খাত, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও ননব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনসহ সব প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হোক। তিনি বলেন, এসব করতে গেলে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। তবে তাতেও ভালো ফল পাওয়া যাবে না, যদি এই কমিশনকে ক্ষমতা না দেওয়া হয়।
ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা যদি যথাযথ হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত নিরীক্ষা ও তদারকির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দ্রুত শনাক্ত করতে হবে। খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করা বা ভুল আর্থিক বিবরণী প্রকাশের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া তারল্যসংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংককে দুই ধাপে পদক্ষেপ নিতে হবে- স্বল্পমেয়াদি সমাধান এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে তারল্য সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন বলেন, টেকসই ও শক্তিশালী ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত তৈরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় দায়িত্ব আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশিকা থাকার পরও বিগত বছরগুলোতে অনেক ব্যাংকই রাজনৈতিক প্রভাবের আশ্রয় নিয়ে এসব নীতিমালা অগ্রাহ্য করে গেছে। ফলে, আর্থিক খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন খেলাপি ঋণ হয়েছে লাগামহীন। তার মতে, এই বিশৃঙ্খলা এখন থেমেছে। উন্নতির পথে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত। তিনি বলেন, অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনতে পারে। যে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন এবং আর্থিক খাত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই খাত-সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় আইন, গাইডলাইন এবং যথাযথ সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন, গাইডেন্স এবং তদারকি বাড়াতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। ব্যাংক সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে।