মোঃ সাইফুল ইসলামঃ
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধে চালু করা হয় ম্যাট্রিক্স পদ্ধতি। ই-টেন্ডারিংয়ের (অনলাইন) মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রকল্প কর্তৃক নির্ধারিত প্রাক্কলিত মূল্যও নির্ধারণ করা থাকে। এই মূল্যের ১০ শতাংশ কম যে বা যারা উদ্ধৃত করতে পারে, কেবল তারাই কাজ পায়। এই প্রাক্কলিত মূল্য সিলগালা খামবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু কিছু নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান বারবার প্রাক্কলিত মূল্য জেনে ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি ক্রয় আইন, ২০০৬ এবং এর বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধন করে দুর্নীতির পথ বন্ধের নির্দেশ দেন। যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে একই প্রতিষ্ঠানকে একাধিক কাজ না দেওয়ারও নির্দেশনা দেন।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত একনেক সভায়ও বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে না পারা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইন ও বিধিমালা সংশোধনের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ২০টি প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করেছে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি বা বিপিপিএ। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষেত্রবিশেষে জাল কাগজপত্র তৈরি করে কাজ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। কাজ সম্পন্ন না করেই অগ্রিম ৫০ শতাংশ টাকা উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ না করেই সমুদয় বিল উঠিয়ে নিয়েছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠান (বিপিপিএ) শুধু কারণ দর্শানোর মধ্যেই দায় এড়াতে চাইছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এরকম বাস্তবতায় যোগ্য প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রকল্পে দরপত্র দাখিলে উৎসাহ হারাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো প্রকল্পে মাত্র একটি বা দুটি দরপত্র দাখিল হচ্ছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, একটি সিন্ডিকেট প্রকল্প পরিচালকেদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রাক্কলিত মূল্যের ১০ শতাংশ কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করার বিষয়টি জেনে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। কারণ ম্যাটিক্স পদ্ধতিতে দরপত্র মূল্যায়নের প্রথম মানদণ্ডই হচ্ছে যথাযথ প্রাক্কলিত মূল্য উদ্ধৃত করা। অতিগোপনীয় এই মূল্য একমাত্র প্রকল্প পরিচালকের কাছেই সংরক্ষিত থাকে। সরকারি ক্রয় আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য পাচারের অভিযোগেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই আইনের বিধান লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী অসদাচরণের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি বিধান লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া এ ধরনের অসৎ কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি সব প্রকল্পে দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিদ্যমান বাস্তবতায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির বিরুদ্ধেও যোগসাজশের অভিযোগ তুলছেন। এভাবে কাজ গ্রহণকারীদের কোনো জবাবদিহি নেই। তারা স্বেচ্ছাধীনভাবে কাজ করেন। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করে বিল তুলে নিচ্ছেন, কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে।
যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বি-বাড়িয়ার নবীনগর-শিবপুর-রাধিকা রোডের প্রতিরক্ষামূলক কাজ নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ না করেই জামানতসহ সমুদয় বিল উঠিয়ে নিয়েছে। একই প্রকল্পে অপর একটি প্রতিষ্ঠানও একই অপরাধ করেছে।এ ছাড়া উক্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের অনেকেই দরপত্র দাখিলের সময় মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স সনদও জাল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রস্তাব মূল্যায়নে প্রকল্প পরিচালকদের দায়িত্ব থাকলেও তাদের চোখে এসব জাল-জালিয়াতি ধরা পড়েনি বা তারা উপেক্ষা করে গেছেন।
সাবেক সচিব এবং সিপিটিইউএর সাবেক ডিজি ফারুক হোসেন এ বিষয়ে বলেন, কেউ আইন উপেক্ষা করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, তবে সরকারি তহবিলের অপচয় করার বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের সব স্তরে দুর্নীতি বন্ধে সব ধরনের প্রচেষ্টা রয়েছে। এর পরেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে নিশ্চই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি ক্রয় আইনের ও বিধানাবলির সংশোধন দ্রুতই শেষ হবে। এটি একটি যৌথ প্রচেষ্টার বিষয়। সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডার দাতা সংস্থা সবার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
সিপিটিইউএর ডিজি রোহেল হোসেন চৌধুরী বলেন, ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় কোনো প্রতিষ্ঠানকে তিন দিন, কাউকে ১০ দিন সময় দিয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে। প্রাক্কলিত দর ফাঁস করার অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে তিনি দাবি করেন। তবে এ পর্যন্ত কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা সুস্পষ্ট করতে পারেননি এই কর্মকর্তা। বরং অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অভিযোগ ফেলে রাখা হয়েছে।