
>বাড়ছে সারের উৎপাদন, কমছে আমদানিনির্ভরতা
> উৎপাদনে চার কারখানা, আসছে আরও একটি>
> এখনো বছরে ৪০ লাখ টন আমদানি
> আমদানির তুলনায় উৎপাদনে খরচ অর্ধেক
নিজস্ব প্রতিনিধি:
চলতি বছরের মাঝামাঝি গ্যাস সংকটে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) চারটি ইউরিয়া সার কারখানার তিনটিই বন্ধ হয়েছিল। সে সময় বোরো মৌসুমে সার সংকটের বড় শঙ্কা তৈরি হয়। তবে দ্রুত কারখানাগুলো উৎপাদনে ফেরা ও সরকারের আমদানির সিদ্ধান্তে সে পরিস্থিতি কেটে গেছে। আসন্ন বোরো মৌসুমে সার সংকটের শঙ্কা নেই। একই সঙ্গে দেশে সারের উৎপাদন বাড়ায় আমদানিনির্ভরতাও কমছে।
দেশে ইউরিয়া সারের মূল জোগান নিশ্চিত করে বিসিআইসি। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে তাদের কাছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার টন সার মজুত রয়েছে। পাশাপাশি চারটি ইউরিয়া সার কারখানা পুরোদমে চালু। এতে প্রতিদিন ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদন হচ্ছে। একই সঙ্গে চারটি আলাদা ক্রয় প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রায় দুই লাখ টন ইউরিয়া সার বিদেশ থেকে কেনা হয়েছে।
কৃষক পর্যায়ে এখনো সার নিয়ে সংকট হয়নি। তবে কৃষকদের সার কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এবার প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে
বোরো মৌসুমের জন্য সারের প্রয়োজন প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টন। চাষের জন্য জানুয়ারি মাসে সারের চাহিদা রয়েছে ৪ লাখ ও ফেব্রুয়ারিতে ৩ লাখ টন। বর্তমানে মজুত ও দুই মাসের উৎপাদিত সার দিয়েই ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলবে। এছাড়া আরও ২ লাখ টন সার মধ্যপ্রাচ্যের ইউএই, কাতার ও সৌদি আরব থেকে আমদানি হচ্ছে, যা জানুয়ারিতে দেশে পৌঁছাবে।
এদিকে দেশের সবচেয়ে বেশি সার উৎপাদনকারী কারখানা যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড এখন পুরোদমে চলছে। দিনে এ কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৭০০ টন। এছাড়া শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডে নিয়মিত উৎপাদন হচ্ছে।
বিসিআইসির পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) শাহীন কামাল জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে অনেক দিন পর আমাদের সবগুলো কারখানা একসঙ্গে চলছে। এটা বড় স্বস্তির খবর। প্রতিদিন নিয়মিত উৎপাদন হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) ৩ হাজার ৮০০ টন সার উৎপাদন হয়েছে, আগের দিন হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টন। এখন আমরা খুব ভালো অবস্থায় আছি। এ বছর (অর্থবছর) ২ লাখ ৯৫ হাজার টন সার উৎপাদন হয়েছে, কিছুদিন বন্ধ থাকার পরও।
তিনি বলেন, উৎপাদনের বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ইউরিয়ার দেশি চাহিদার কোনো সমস্যা হবে না, বরং আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। তারপরও তিন দেশ থেকে জি-টু-জি চুক্তি করা রয়েছে সার আমদানির জন্য। সেগুলো আসছে।
বর্তমানে অনেক দিন পর আমাদের সবগুলো কারখানা একসঙ্গে চলছে। এটা বড় স্বস্তির খবর। প্রতিদিন নিয়মিত উৎপাদন হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) ৩ হাজার ৮০০ টন সার উৎপাদন হয়েছে, আগের দিন হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টন। এখন আমরা খুব ভালো অবস্থায় আছি।
এদিকে আসন্ন বোরো মৌসুমে সার পরিস্থিতি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ শাখার অতিরিক্ত সচিব ড. শাহ্ মো. হেলাল উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা চাষিদের নিশ্চিত করতে পারছি যে, এবার সারের কোনো সংকট নেই। সবাই সুষ্ঠুভাবে সার পাবেন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত সার রয়েছে। বিশেষ করে বোরোর জন্য কোনো চিন্তা নেই।
স্থানীয় কারখানাগুলো এখন বছরে প্রায় ১০ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদন করে, বাকি চাহিদা মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। তবে গত ১২ নভেম্বর উদ্বোধন হওয়া ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানাটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে। এ কারখানায় ইউরিয়ার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৯ লাখ টন। এটি পুরোদমে উৎপাদনে এলে আগামীতে সার আমদানি আরও কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিসিআইসির গবেষণা শাখার তথ্য বলছে, দেশে উৎপাদিত সারের চেয়ে আমদানি করা সারের দাম প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সারের আমদানিতে গড়মূল্য ছিল ৭৭ হাজার টাকা, যা এ বছর কিছুটা কমে এখন পর্যন্ত ৬২ হাজার টাকায় এসেছে। যেখানে দেশে স্বাভাবিক গ্যাসের চাপে প্রতি টন সার উৎপাদনে খরচ হয় সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা।
শাহিন কামাল বলেন, আমরা উৎপাদন ঠিক রাখতে পারলে অর্ধেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব। এবার সে টার্গেট নিয়ে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। আমাদের ডলার সংকট রয়েছে। এটিও উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়ার একটি বড় কারণ।
সৌদি আরব, মরক্কো, তিউনিশিয়া, কানাডা, রাশিয়া ও বেলারুশ-এ ছয় দেশের সঙ্গে নন-ইউরিয়া সার আমদানির চুক্তির ধারা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে চীন, মালয়েশিয়া ও জর্ডান-এ তিন দেশ থেকেও নন-ইউরিয়া সার আমদানি করা হবে
এদিকে গত বছরের অক্টোবরে কৃষক পর্যায়ে সার সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। তখন কয়েকটি জেলায় কৃষকরা বাড়তি দাম চাওয়া এবং সার না পাওয়ায় বিক্ষোভ করেছিলেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষক পর্যায়ে এখনো সার নিয়ে সংকট হয়নি। তবে কৃষকদের সার কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে বলেও কিছু অভিযোগ রয়েছে। এবার প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশে নন-ইউরিয়া হিসেবে মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), ট্রিপল সুপার ফসফেটসহ (টিএসপি) অন্যান্য সার সরবরাহের বিষয়টি দেখে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। বিএডিসির কর্মকর্তারাও বলছেন, চলতি মৌসুমে এসব সারেরও কোনো সংকট হবে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব সার মিলে চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টনের কিছু বেশি। এরমধ্যে প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বাকিটা দেশের কারখানায় উৎপাদন হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিটুজি চুক্তির আওতায় ৯ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সৌদি আরব থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন, কাতার থেকে ৩ লাখ টন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টন সার আমদানি করা হবে। এছাড়া সৌদি আরব, মরক্কো, তিউনিশিয়া, কানাডা, রাশিয়া ও বেলারুশ-এ ছয় দেশের সঙ্গে নন-ইউরিয়া সার আমদানির চুক্তির ধারা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে চীন, মালয়েশিয়া ও জর্ডান-এ তিন দেশ থেকেও নন-ইউরিয়া সার আমদানি করা হবে।
দেশে সার উৎপাদন বা আমদানিতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, সরকার তারচেয়ে অনেক কম দামে সার বিক্রি করে। অর্থাৎ সারে ভর্তুকি দিতে হয় প্রতি বছর। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় সারে ভর্তুকি দ্রুত বাড়ছে। এ দাম সমন্বয়ে সরকার গত এপ্রিলে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ায়। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা করা হয়।