এমপি-মন্ত্রী হয়ে বদলে যান আব্দুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে ড. আব্দুর রাজ্জাক পরিচিত ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে। আওয়ামী লীগের এই নেতার নির্বাচনী এলাকা টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধনবাড়ীতে কোনো বাড়িও ছিল না। পুরোনো মডেলের গাড়ি নিয়ে এলাকায় আসতেন।

দ্বিতীয় দফায় এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর চালচলন বদলে যায়। দলের ও সরকারি উন্নয়নকাজে আধিপত্য বিস্তার; আত্মীয়স্বজন ও অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে দলীয় পদ-পদবি দখল, সব নির্বাচনে অনুগতদের বিজয়ী করা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখলসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই ড. রাজ্জাকের গ্রেপ্তারের খবরে মধুপুর ও ধনবাড়ীতে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা ও বিএনপির নেতাকর্মীরা।
ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াদুদ তালুকদার সবুজ সমকালকে বলেছেন, ক্ষমতায় থাকতে মধুপুর ও ধনবাড়ীতে আব্দুর রাজ্জাকের কথাই শেষ কথা ছিল। প্রভাবশালী এই নেতা নিজে এবং ১৫ বছর আগেও তাঁর যেসব আত্মীয়স্বজনের কিছুই ছিল না, তারাও কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি করতে গিয়ে দলের ভেতরে বিভেদ তৈরি করেছেন রাজ্জাক। ত্যাগী নেতাকর্মীকে উপেক্ষা করেছেন। নিজ দলের লোকজনকে মামলা করে জেল খাটিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) টাঙ্গাইলের সাধারণ সম্পাদক তরুণ ইউসুফ বলেন, হয়তো এতদিন ভয়ে ড. রাজ্জাক ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেনি। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
যেভাবে উত্থান
সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম এমপি হন আব্দুর রাজ্জাক। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তাঁর জীবনযাপন ছিল সহজ-সরল। দলীয় ও এমপির দায়িত্ব পালনের বেলায় প্রাধান্য পাননি কোনো আত্মীয়স্বজন। এই নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে খাদ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পরই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দল ও সরকারি কাজে আধিপত্য বিস্তার করেন। আত্মীয়স্বজন ও অনুগত ব্যক্তিদের পদ-পদবি ও জনপ্রতিনিধি বানিয়ে নেতৃত্বে বসাতে শুরু করেন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখলসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. রাজ্জাক ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে হন কৃষিমন্ত্রী। এর পর থেকে পুরো টাঙ্গাইল জেলাই চলে আসে তাঁর একক নিয়ন্ত্রণে। জেলার বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেন তাঁর আত্মীয়স্বজন।
সম্পদের পাহাড়
রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে ড. রাজ্জাকের রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। আমেরিকায় রয়েছে একাধিক পেট্রোল পাম্প, সুপারশপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।
ধনবাড়ীর ভাইঘাট পালবাড়ীর মতি ড্রাইভারের ছেলে রাব্বির মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই রাব্বি স্ক্যামিং পর্নোগ্রাফি ব্যবসায় জড়িত থাকায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর নামে সিআইডি থেকে মামলা করা হয়েছিল। পরে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মাধ্যমে মামলা থেকে রাব্বির নাম কাটিয়ে নেন রাজ্জাক।

আব্দুর রাজ্জাক তাঁর আমেরিকা ও সুইডেনপ্রবাসী ভাইদের কাছেও অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর আপন ভাই মুশুদ্ধি ইউপির চেয়ারম্যান কায়সারের রয়েছে হাজার বিঘা জমি। বলিভদ্র এলাকায় কারখানা করার জন্য শত শত একর কৃষিজমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত কায়সার নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ধনবাড়ীর মুশুদ্ধিতে নদী দখল করে রাজ্জাকের মায়ের নামে রেজিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করায় ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে এলাকাবাসী জাতীয় নদী কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিলেও রাজ্জাকের প্রভাবে তদন্ত হয়নি।

ড. রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুনুর রশিদ হিরার রয়েছে পেট্রোল পাম্প, কয়েকশ বিঘা জমি এবং রাজধানীর বসুন্ধরায় দশ তলা দুটি ভবন। আরেক খালাতো ভাই দেলোয়ার বিআরটিএ থেকে অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে ঢাকায় করেছেন ফ্ল্যাট ও বাড়ি। খালাতো ভাই রিপনও কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুর্নীতির দায়ে আরেক খালাতো ভাই বিআরটিএতে চাকরিরত শহীদুল্লাহ কায়সারের চাকরি চলে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে রাজ্জাক মন্ত্রী হওয়ার পর শহীদুল্লাহ কায়সারকে চাকরি ফেরত দিয়ে বিআরটিএর পরিচালক করা হয়। এই খালাতো ভাইও তিতাস ফিলিং স্টেশন নামে পেট্রোল পাম্পসহ ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট এবং নামে-বেনামে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। এদিকে সাবেক এই মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদের নামেও রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কিনেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মাসুদের দুর্নীতির কারণে সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন মামলা করলে সেটি সাবেক আইনমন্ত্রীর মাধ্যমে খারিজ করান রাজ্জাক।

আত্মীয় ও অনুগতদের দিয়ে অপকর্ম
আব্দুর রাজ্জাকের পক্ষে হারুনুর রশিদ হিরা এবং মামাতো ভাই নূরানি কনস্ট্রাকশনের মালিক তরিকুল ইসলাম তারেক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং গণপূর্তসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ ভাগাভাগির অঘোষিত নিয়ন্ত্রক বনে গিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো রাজ্জাককে। বাকি কাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন তিনি।

রাজ্জাক ও তাঁর সিন্ডিকেটের অনুগত গুটিকয় ঠিকাদার ছাড়া বেশির ভাগ দরপত্রে অন্য কেউ অংশ নিতেও পারতেন না। টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের মতো বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেন তারেক। এসব কাজে রাজ্জাকেরও সমান ভাগ ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে টাঙ্গাইল চেম্বারের সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন তারেক।

এ ছাড়া ড. রাজ্জাক কয়েকজন অনুগতকে দিয়ে এলাকাকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেন। যারা সাধারণ মানুষের জমি, বাড়ি ও পুকুর দখলসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই অনুগতদের মধ্যে ছিলেন মধুপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র সিদ্দিক হোসেন খান, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ সজীব, যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন শিমুল, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।