সাজ্জাদ হসেন:
বিশ্ববিখ্যাত কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা ইউরোপীয় বাজার থেকে তাদের কয়েকটি জনপ্রিয় পানীয় সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নিয়মিত পরীক্ষায় ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্লোরেট উচ্চমাত্রায় শনাক্ত হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কোকা-কোলার বিবৃতিতে বলা হয়, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও নেদারল্যান্ডস থেকে এরই মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাচের পণ্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে সমস্যাটি আপাতত ইউরোপের কিছু দেশে সীমাবদ্ধ।
তবে কোকা-কোলার মতো একটি বহুজাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত এমন খবরে এর প্রভাব স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে অন্যান্য অঞ্চলের ভোক্তাদের আস্থার ওপরও পড়তে পারে। বিশেষত বাংলাদেশে; যেখানে কোকা-কোলা খুব জনপ্রিয় এবং ভোক্তার আস্থা তাদের বাজারের অন্যতম শক্তি। এমন খবর শুনে কিছু ভোক্তা সতর্ক হয়ে পণ্যটি ব্যবহারে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারেন।
ক্লোরেট কী এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব
ক্লোরেট হলো একটি রাসায়নিক পদার্থ; যা সাধারণত পানি শোধন এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত ক্লোরিনভিত্তিক জীবাণুনাশক থেকে উৎপন্ন হয়। এটি কিছু ক্ষেত্রে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণেও দেখা যায়। উচ্চমাত্রার ক্লোরেট শরীরে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শিশু ও নবজাতকদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ক্লোরেট শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। এটি বমি, ডায়রিয়া, মাথা ঘোরা এবং রক্তের অক্সিজেন শোষণে বাধা সৃষ্টি করে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি শিশুস্বাস্থ্যের ওপর আরও গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা (ইফসা) ২০১৫ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় জানায়, খাবার বা পানীয়তে ক্লোরেটের অনুমোদিত সীমা ছাড়িয়ে গেলে তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
কীভাবে এই সমস্যা শনাক্ত হলো
বেলজিয়ামের গেন্ট শহরে অবস্থিত কোকা-কোলার একটি উৎপাদন কেন্দ্রে নিয়মিত পরীক্ষার সময় সমস্যাটি ধরা পড়ে। কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাচগুলো এরই মধ্যে বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বেলজিয়ামের অধিকাংশ স্টোর থেকে কাচের বোতল ও ক্যান তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে ফ্রান্সের পরিস্থিতি ভিন্ন। ফ্রান্সে কোকা-কোলার শাখা জানিয়েছে, পরীক্ষায় ক্লোরেট শনাক্ত হলেও তা অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ফলে ফ্রান্সে কোনো পণ্য প্রত্যাহার করা হয়নি।
কোন পণ্যগুলোতে সমস্যা শনাক্ত হয়েছে
কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সমস্যাগ্রস্ত পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাপলটাইজার, কোকা-কোলা অরিজিনাল টেস্ট, কোকা-কোলা জিরো সুগার, ডায়েট কোক, স্প্রাইট জিরো, ফান্টা এবং মিনিট মেইডের নির্দিষ্ট কিছু ব্যাচ। এগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্লোরেট নামক ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাচগুলো বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব পড়ার শঙ্কা
বিশ্বব্যাপী কোকা-কোলার জনপ্রিয়তার কারণে এই সংকটের খবর বাংলাদেশের বাজারেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘যেহেতু ইউরোপের কিছু দেশে ক্লোরেট সমস্যার প্রমাণ মিলেছে, আমাদের দেশের বাজারে প্রচলিত কোমল পানীয়ের নমুনাও পরীক্ষা করা উচিত। সাধারণত প্রায় সব কোম্পানির কোলাজাতীয় পানীয় কাছাকাছি ফর্মুলায় তৈরি। তাই ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে দ্রুত নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা জরুরি।’ দেশে কোকা-কোলার বড় বাজার। তবে নিরাপত্তা নিয়ে এমন কোনো খবর ভোক্তাদের আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও এ বিষয়ে কোকা-কোলা বাংলাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি।
কোম্পানির বক্তব্য ও পদক্ষেপ
কোম্পানির এক মুখপাত্র ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানান, পানীয়গুলোতে ক্লোরেটের উপস্থিতি খুবই কম এবং তা গ্রাহকদের জন্য বড় কোনো ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবু গ্রাহকদের স্বাস্থ্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার জন্যই সমস্যাগ্রস্ত ব্যাচগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ফুড স্ট্যান্ডার্ডস এজেন্সি (এফএসএ) বিষয়টি তদন্ত করছে। সংস্থাটি জানায়, ‘যদি আমরা কোনো অনিরাপদ পণ্য শনাক্ত করি, তা বাজার থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হবে এবং ভোক্তাদের সতর্ক করা হবে।’
বাংলাদেশে কোকা-কোলার যাত্রা
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ হিসেবে কোকা-কোলার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬২ সালে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে আব্দুল মোনেম লিমিটেডের (এএমএল) মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে বোতলজাত পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। ১৯৯০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বাজারে ৭০ শতাংশ দখল করে এটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোমল পানীয় ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় কোকা-কোলা।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এবং আইসিডিডিআরবির মতো প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে বাংলাদেশে প্রচলিত কোমল পানীয়গুলো ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর উচিত নিয়মিত তাদের পণ্যের মান নিশ্চিত করা এবং কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া।