গাইবান্ধায় ঝিনুক থেকে চুন তৈরির ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে তিন পরিবার

প্রকাশিত: ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫

গাইবান্ধা  প্রতিনিধি:

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাদিয়াখালি ইউনিয়নের রিফাইত সরকারতারি গ্রামে আজও টিকে আছে ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরির প্রাচীন ঐতিহ্য। বংশপরম্পরায় এ পেশায় নিয়োজিত সনাতন ধর্মাবলম্বী তিন পরিবার এখনও তাদের পূর্বপুরুষদের শেখানো পদ্ধতিতে চুন তৈরি করে আসছে। তাদের উৎপাদিত চুন স্থানীয় বাজারে চাহিদা পূরণ করে আসছে, তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও সরকারি সহায়তার অভাবে এ শিল্পটি বিলুপ্তির পথে।

চুন তৈরির এই পদ্ধতি হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে এটি প্রথম প্রচলিত হয়। প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যায়, চীন ও রোমান সভ্যতাতেও এই পদ্ধতির ব্যবহার ছিল। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে চুনের ব্যবহার শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতক আগে। এটি তখন থেকেই পান খাওয়ার ঐতিহ্যের অংশ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

রিফাইতপুর গ্রামের চুনারু বা যুগী পরিবারের তৈরি চুন সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে উৎপাদিত। চুন তৈরির প্রধান উপকরণ ঝিনুক বা সিঁপি। প্রথমে স্থানীয় নদী, বিশেষ করে গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়। ঝিনুক রোদে শুকিয়ে বিশেষভাবে সাজানো ভাটিতে খড়ি দিয়ে পোড়ানো হয়। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা তাপে পোড়ানোর পর তৈরি হয় ‘ঝুড়ি’। এরপর আধুনিক শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ব্যালেন্ডার মেশিনে ঝুড়ি ও পানি মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ঘষামাজার পর চুন প্রস্তুত করা হয়। যুগী পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই এ কাজ করেন। প্রতিটি ধাপ খুব যতেœর সঙ্গে সম্পন্ন করেন তারা।এক সময় এ পেশায় নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। বর্তমানে যুগী পরিবারের সুভাস চন্দ্র দেবনাথ, বর্ণ চন্দ্র দেবনাথ এবং স্বপন চন্দ্র দেবনাথ এই তিন ভাই তাদের বংশীয় ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

 

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে তারা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।

স্বপন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আমরা আমাদের বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে আমরা এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে পারতাম।

বর্ণ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আমাদের উৎপাদিত চুন স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হয় এবং এর ভালো চাহিদা রয়েছে। তবে আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ধীর এবং শ্রমসাপেক্ষ হয়ে পড়েছে।

গাইবান্ধা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) মহাব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল ফেরদৌস বলেন, জেলার ৬ জন যুগীকে প্রায় ১০ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে জেলার মোট যোগীর সংখ্যা সম্পর্কে তার কাছে সঠিক তথ্য নেই।

গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ আল হাসান বলেন, ছোট ছোট এ ধরনের শিল্পের প্রসারে উপজেলা প্রশাসন সব ধরনের সহযোগিতা করবে। তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রিফাইত সরকারতারি গ্রামের চুন উৎপাদন প্রক্রিয়া শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। এটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমাজের সচেতন মহলের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।