নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারা ক্ষমতায় যাবে, তার পূর্বাভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল। তবে বিরোধী দল কারা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রতিনিধি দল সংসদে বিরোধী দল কারা হবে, ভোটের আগেই তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। সংসদে নির্বাচনের আগে তৈরি হওয়া ওই প্রশ্নের জবাব নির্বাচনের পর প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চললেও এখনও মেলেনি। এখনও সুরাহা হয়নি সংসদে বিরোধী দলের ইস্যুটি। অবশ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে প্রধান বিরোধী হওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। সেই অনুযায়ী দলটি তার সংসদীয় দলের নেতা ও উপনেতা নির্বাচনসহ বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ এবং একজন হুইপ মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। দলটি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়ে বিরোধী দলীয় নেতাসহ সংশ্লিষ্ট পদগুলোর স্বীকৃতি পেতে স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরদিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের জোটবদ্ধভাবে বিরোধী দলের ভূমিকার থাকার কথা শোনা গেলেও তাতে খুব একটা হালে পানি পায়নি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী এই স্বতন্ত্র এমপিদের বেশিরভাগই বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে অনাগ্রহী। তারা যে কোনও ফরম্যাটে সরকারের কাছাকাছি থাকতে চায়।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দলটি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে ইতোমধ্যে সরকারও গঠন করেছে। অপরদিকে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। দলটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। এবার তার তুলনায় ১২টি আসন কম পেয়েছে। এর বাইরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জিতেছে। অপরদিকে স্বতন্ত্র হয়ে লড়ে ৬২ জন প্রার্থী জিতেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৫৮ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনও না কোনও পদে রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজন রয়েছেন সরাসরি একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের টিকিটে বিজয়ী। যারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবার রেকর্ড সংখ্যক আসনে জয়ী হওয়া এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনধারী রাজনৈতিক দলের আসন সংখ্যা একাদশের তুলনায় অর্ধেকেরও কমে নেমে আসায় সংসদে বিরোধী দল কারা হবে ভোটের ফলাফলের পর থেকেই সেই বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টানা তিনবার বিজয়ী ফরিদপুর-৪ আসনের মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) ও ফরিদপুর-৩ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুল কাদের আজাদসহ (এ কে আজাদ) কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি জোটবদ্ধ হয়ে বিরোধী দলের যাওয়ার আভাস দেন। ৯ জানুয়ারি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের দিনও তাদের কেউ কেউ একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তবে পরবর্তী সময়ে তাদের আলোচনার অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। বরং বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগেই বিরোধী দলে যাওয়ার পক্ষে নন। তারা যেকোনোভাবে সরকারের সঙ্গে থাকতে চান। বতর্মানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা বা সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী এসব স্বতন্ত্র এমপিরা সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের পদও ধরে রাখতে চায়। অন্তত দুজন স্বতন্ত্র এমপির সাথে আলাপ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
হবিগঞ্জ-১ আসনের আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া, বরিশাল-৪ পঙ্কজ নাথ, ময়মনসিংহ-৭ এ বি এম আনিছুজ্জামান, ময়মনসিংহ-৮ মাহমুদ হাসান, নীলফামারী-৩ সাদ্দাম হোসেন পাভেল, নওগাঁ-৬ আসনের অ্যাডভোকেট ওমর ফারুকসহ বেশিরভাগই বিরোধী দলে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। হবিগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র এমপি আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া বলেন, ‘স্বতন্ত্র জোট আমার কাছে একটি অসহ্য ব্যাপার, আমি তা চাই না। আমি আওয়ামী লীগের। স্বতন্ত্র এমপি হয়েছি বলে বিরোধী দল, এটি মেনে নিতে পারছি না।’
ময়মনসিংহ-৭ আসনের এ বি এম আনিছুজ্জামান বলেন, ‘আমি এখনও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। নেত্রী যেভাবে বলবেন, সেভাবেই এগিয়ে যাবো।’
অবশ্য স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে চেয়েছেন নাটোর-১ আসনের আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘স্বতন্ত্র এমপিরা যার যার পদ-পদবি অনুযায়ী নিজ নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন।’
এদিকে শপথ গ্রহণের পর থেকে জাতীয় পার্টি বলে আসছে তারা সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনধারী রাজনৈতিক দল হিসেবেই তারাই আইনত এ সুযোগের অধিকারী। ইতোমধ্যে দলটির সরকারি দলের তরফ থেকে এ বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আগেই দাবি করেছেন, যত আসনই জিতুক না কেন, জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হবে। তার দাবি, ‘বিরোধী দল গঠন করতে হলে একটি দল থাকতে হয়। কিন্তু স্বতন্ত্ররা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়।’
জাতীয় পার্টি বৃহস্পতিবার তার সংসদীয় দলের সভা করেছে। ওই সভায় চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদীয় দলের নেতা ও কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে সংসদীয় উপনেতা নির্বাচন করা হয়। এছাড়া পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদকে বিরোধী দলীয় হুইপও মনোনয়ন দেওয়া হয় ওই সভায়। সভায় দলের এই সিদ্ধান্তের আলোকে বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য পদের স্বীকৃতি পেতে স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জানা গেছে, দলটি রবিবার স্পিকারকে চিঠি দিতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদীয় দলের উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমরা সংসদীয় দল থেকে বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এই সিদ্ধান্ত স্পিকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। স্বীকৃতি দেওয়ার এখতিয়ার স্পিকারের। স্বীকৃতি হোক না না হোক তারা সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবেন বলেও জানান সাবেক এই মন্ত্রী।
দলের সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘তারা স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চিঠিটি এখনও পাঠানো হয়নি। আগামী সপ্তাহের শুরুতেই তারা স্পিকারের দফতরে চিঠিটি দেবেন।’ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিরোধী দলীয় নেতার স্বীকৃতি পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ দলীয় সিনিয়র সংসদ সদস্য সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, তাদের সংসদীয় দলের সভায় (৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত) বিরোধী দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি যেহেতু স্পিকারের এখতিয়ারভুক্ত তিনি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমানে নির্বাচনি এলাকা রংপুরে সফররত স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, তার জানামতে বিরোধী দলীয় নেতার স্বীকৃতির বিষয়ে এখনও কোনও দল বা জোটের চিঠি তার দফতরে আসেনি। চিঠি পেলে আইন-বিধি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, স্বতন্ত্র এমপিদের জোটবদ্ধ হয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন বা স্বতন্ত্র এমপিদের কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া— দুটো বিষয় নিয়েই ধোঁয়াশা রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা দুই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এরইমধ্যে আগামী ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ডাকা হয়েছে। তার আগেই সংসদে বিরোধী দল বা বিরোধী দলীয় নেতার প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।