জেলা প্রতিনিধি,কুষ্টিয়াঃ
দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের সব কটি পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। এতে প্রকল্পের আওতাধীন দক্ষিণ-পশিমাঞ্চলের চার জেলায় বোরো ধানসহ খাদ্যশস্য উৎপাদনে সেচ সরবরাহ বন্ধসহ পুরো প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেচের অভাবে বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়সহ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন কৃষি কর্মকর্তারা ও কৃষকেরা।
চলতি খরা মৌসুমে পদ্মা নদী ও পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াইতে পানি সংকটে জেলার সর্বত্র নেমে গেছে পানির স্তর। গভীর-অগভীর নলকুপে পানি না ওঠায় জীব-বৈচিত্র্যের বিপর্যয়সহ দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট ।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় স্থাপিত জি-কে সেচ প্রকল্পের তিনটি মেইন পাম্প মেশিনের মধ্যে ২০১৭ সালে (১ নম্বর) মেশিনটি বিকল হয়। ওই পাম্পটি মেশিনটি মেরামতের পর ২০২২ সালে তা পুনরায় অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে দুই বছর যাবত মেশনটি বিকল। পরবর্তীতে ২০২১ সালে (২ নম্বর) জাপানি কোম্পানির সেচ পাম্প মেশিনটি বিকল হয়। জাপানি প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে বিকল ওই পাম্প মেশিনটি মেরামতের চেষ্টার পরও চালু না হওয়ায় ওই পাম্প মেশিনটিও অকেজো গত তিন বছর ধরে। প্রকল্পের ৩ নম্বর সেচ পাম্পটির মাধ্যমে খুঁড়িয়ে চলছিল সেচ সরবরাহ। চলতি ২০২৪ সালের জানুয়ায়ি মাসে যান্ত্রিক ক্রুটিতে ওই সেচ পাম্পটিও অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে সেচ প্রকল্পের তিনটি মেইন পাম্প মেশিনই এখন অচল।
এতে বোরো ধানসহ খাদ্য-শষ্য উৎপাদনের ভরা মৌসুমে চলছে চরম সেচ সংকট। তবে প্রকল্পের তিনটি পাম্প মেশিন একযোগে মেরামতের জন্য প্লানিং কমিশনে ডিপিপি পাঠানোর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানালেও পাম্প মেশিনগুলো মেরামতে সরকারি অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্ধে দীর্ঘসূত্রতা পিছু হটছে না। পাম্প মেশিন বিকল ছাড়াও নদী থেকে পানি উত্তোলন করে প্রধান খাল মেইন ও শাখা খালে সেচ সরবরাহে প্রয়োজনীয় পানি এখন নেই পদ্মা নদীতে। সিডিউল মোতাবেক পাম্প মেশিন চালু করতে পদ্মা নদীর ইনটেক চ্যানেলের মুখে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার পানি সমতল লেভেল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখন পানির লেভেল আছে চার মিটারের নিচে। সাড়ে চার মিটারের নিচে পানির লেভেল থাকা অবস্থায় মেশিন সুইচ করা হলে পাম্প মেশিনে প্রচন্ড ঝাঁকুনিসহ অতিরিক্ত গরম ও বিয়ারিং ঘর্ষণে মটর পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ফলে চার জেলার কৃষকের মাথায় হাত ও কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। জিকে প্রকল্পের সেচ সরবরাহ একেবারে বন্ধ থাকায় প্রকল্পের মেইন ও শাখা-উপশাখাগুলো এখন পানিশূন্য।
প্রতি বোরো মৌসুমে প্রকল্পের আওতায় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ঝিনাইদহ ও মাগুরাসহ চার জেলায় হাজার হাজার হেক্টর জমিতে নিরবচ্ছিন্ন সেচ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এবারের বোরো মৌসুমে পুরো বন্ধ সেচ কার্যক্রম। মাঠে মাঠে এখন ধানের থোড় থেকে গজিয়েছে পরিপূর্ণ শীষ । এই সময় প্রতিটি ধানের গোড়ায় সেচ সরবরাহ অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেচ অভাবে বোরো ধানের আবাদী মাঠে ধানের শীষে পড়েছে চিটা ।
কৃষকেরা বিকল্প হিসাবে অধিক ব্যয়ে জমিতে বরিং করেও শ্যালো ইঞ্জিনে প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। ফলে নিরুপায় কৃষক এখন চরম বিপাকে। সেচ না পেয়ে কৃষকসহ শত শত বর্গা চাষিরা এখন দিশেহারা। এতে বোরো ধান উৎপাদন ব্যাহত ও মারাত্মক ফলন বিপর্যয় আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। জিকে প্রকল্পের আওতায় ৯৫ হাজার ৬শ ১৬ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পাম্প মেশিন তিনটি বিকল হওয়ায় চলতি বছর বোরো ধানি জমিতে সেচ সরবরাহ একবারেই বন্ধ। চাষিরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ চাহিদা মেটাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে কৃষিতে সেচ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কুষ্টিয়াসহ আশেপাশের জেলার হাজার হাজার বাসা-বাড়ির নলকূপেও উঠছে না পানি। ফলে জীব-বৈচিত্র, গৃহস্থালি কাজকর্মসহ জন-জীবনে পড়েছে মারাত্মক বিরুপ প্রভাব।
সেচের অভাবে কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর উপজেলার কাকিলাদাহ মল্লিকপাড়ার মাঠসহ প্রকল্পের আওতাধীন চার জেলার কয়েক হাজার হেক্টর জমি রয়েছে অনাবাদী। মিরপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল খলিল মল্লিক জানান, জি-কে প্রকল্পের সেচ বন্ধ থাকায় শত শত গরীব কৃষকের জীবনে নেমে এসেছে অভিশাপ। সেচের অভাবে চাষাবাদ করতে না পেরে কৃষকের দুঃখ-কষ্টের সীমা নেই। জিকে প্রকল্পের বিকল পাম্প মেশিনগুলো দ্রুত মেরামতসহ সেচ সরবরাহ চালুর দাবি জানান ওই কৃষক।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান জানান, চলতি বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলায় ৩৬ হাজার ৮শ ৩০ হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। কিন্তু জিকে প্রকল্পের সেচ বন্ধ থাকায় ৫শ ২৩ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেনি কৃষকরা। চলতি বোরো মৌসুমে উঠতি ধানের সেচ চাহিদা মেটাতে কৃষকের জমিতে আগে বরিংকৃত শ্যালো মেশিন মাটির কমপক্ষে ১০ ফুট গভীরে প্রতিস্থাপনে কৃষি বিভাগের পক্ষে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নতুন বরিংকৃত শ্যালো মেশিন পরিচালানায় দ্রুত বিদ্যুত সংযোগ পেতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাকে প্রতিনিয়ত তাগিদ দিচ্ছেন কৃষি বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তরা।
জিকে পাম্প হাউজ অপারেশনাল বিভাগের নির্বার্হী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, জি-কে পাম্প হাউজের তিনটি মেইন মেশিনই ধাপে ধাপে অকোজো হয়ে গেছে। মেশিন তিনটি মেরামতের জন্য প্রস্তুতকৃত ডিপিপি প্লানিং কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পাম্প মেশিনগুলো মেরামতের আগে সেচ সরবরাহ চালুর কোন সম্ভবনা নেই।কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহামান বলেন, জি-কে সেচ প্রকল্পের পাম্প মেশিন অকেজো হওয়ায় সেচ সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। বিকল পাম্প মেশিন তিনটি মেরামতে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।