জেনে নেন নির্বাচনকালে মন্ত্রী-এমপিরা কী করতে পারবেন, কী পারবেন না

প্রকাশিত: ১:৪১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৯, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও এই মুহূর্তে নির্বাচনি এলাকায় সরকারি সফরে যেতে বাধা নেই মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারি সুবিধাভোগী ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের। এক্ষেত্রে সফরে তাদের সার্কিট হাউজ, সরকারি যানবাহন ব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় প্রটোকলেও কোনও বাধা নেই। তবে সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনি কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যুক্ত করতে পারবেন না। এদিকে সংসদের উপ-নির্বাচনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনি এলাকায় সফর ও নির্বাচনি প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংসদের সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তি নিজে প্রার্থী না হলে যেতে পারবেন’— এমন কথাও কোথাও স্পষ্টভাবে বলা নেই। অবশ্য ইসি বলেছে, কোনও বিষয়ে অস্পষ্ট থাকলে পরিপত্রের মাধ্যমে তা স্পষ্ট করা হবে।

নির্বাচনি আচরণবিধি পর্যালোচনা ও ইসির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বুধবার (১৫ নভেম্বর) ঘোষণা হয়েছে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ তফসিলের দিন থেকেই শুরু হয়েছে। এ সময়টি শেষ হবে ভোটের ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশের পর। আচরণবিধি অনুযায়ী, নির্বাচনি প্রচারণার সময়কাল শুরু হবে ১৭ ডিসেম্বর। আচরণবিধিতে নির্বাচন-পূর্ব সময় ও প্রচারণার সময়কালে বেশকিছু বিধি-নিষেধের আওতায় পড়বেন ‘অতি গুরত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিরা। আচারণবিধি অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হচ্ছেন— প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, চিফ হুইপ, ডেপুটি হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী ও তাদের সমমর্যাদার ব্যক্তিবর্গ, সংসদ সদস্য ও সিটি করপোরেশনের মেয়ররা।

নির্বাচনি আচরণবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় নির্বাচন-পূর্ব সময়ে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, তা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সংবিধান বা আচরণবিধিতে এ সময়ে সরকারের ধরন কী হবে, তা উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে অন্য সময় সরকার যেভাবে পরিচালিত হয়, নির্বাচনকালীন সময়ও স্বাভাবিক সময়ের মতো সরকার পরিচালিত হবে। এমনকি এ সময়ে সংসদের অধিবেশন বসা বা নীতি নির্ধারণী কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইনত কোনও বাধা নেই। অবশ্য নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে— এমন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা উন্নয়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন-পূর্ব সময়ে (তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশের সময়কাল) কোনও সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনও প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কিংবা ফলক উন্মোচন করা যাবে না। এ সময়ে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনও ধরনের অনুদান ঘোষণা, বা বরাদ্দ প্রদান বা অর্থ অবমুক্ত করতে পারবেন না।

বিধিতে সরকারি ডাক-বাংলো, রেস্ট হাউজ, সার্কিট হাউজ বা কোনও সরকারি কার্যালয়কে কোনও দল বা প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে প্রচারের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না বলে উল্লেখ আছে।

বিধিতে আরও বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনি কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যোগ করতে পারবেন না। অর্থাৎ সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তির নির্বাচনি প্রচারণার সময়সহ নির্বাচন-পূর্ব সময় সরকারি সফরে কোনও ধরনের বাধা নেই। তবে তার কর্মসূচিতে নির্বাচনি সম্পর্কিত কোনও কর্মসূচি রাখা যাবে না।

নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্য কোনও সরকারি সুবিধাভোগ করতে পারবেন না। অর্থাৎ তিনি সরকারি সুবিধা না নিয়ে নিজের বা অন্যের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন।

আচরণবিধিতে উল্লেখ আছে— জাতীয় সংসদের কোনও শূন্য আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচন-পূর্ব সময়ের মধ্যে কোনও সফর বা নির্বাচনি প্রচারণায় যেতে পারবেন না। তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হলে কেবল ভোট প্রদানের জন্য যেতে পারবেন। এ বিধান অনুযায়ী, উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের সফরে বাধা থাকলেও সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা নেই। এক্ষেত্রে কোনও সুবিধাভোগী ব্যক্তি সাধারণ নির্বাচনে নিজে প্রার্থী না হলেও তার যেতে বাধা নেই।

সুবিধাভোগীদের সরকারি সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘আচরণবিধিতে সরকারি সফরে কোনও প্রকার বাধা নেই। সাধারণ সময় সফরে গেলে তিনি প্রটোকলসহ যেসব সুবিধা পান, তার সব সুবিধাই ভোগ করবেন। তবে তার ওই সফরে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও কর্মসূচি রাখা যাবে না।’

এদিকে সাধারণ ও উপনির্বাচনে ভিন্ন ধরনের বিষয় থাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘সাধারণ নির্বাচনে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সাধারণত সবাই নিজেরাই প্রার্থী হন। সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আচরণবিধি করা হয়েছে। প্রার্থী হিসেবে তো প্রচারণার জন্য যাবেন, এটাই স্বাভাবিক।’ তবে কোনও বিষয়ে অস্পষ্ট থাকলে পরিপত্রের মাধ্যমে তা স্পষ্ট করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

মন্ত্রী-এমপিদের সুবিধা প্রশ্নে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নির্বাচনি প্রচারণার কাজ শুরু হবে। এই নির্বাচনি প্রচারণার সময় কোনও মন্ত্রী কোনও ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে না, আর কোনও রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না, এটাই নিয়ম। কিন্তু সরকার থেমে থাকবে না, সরকারি দৈনন্দিন যে কাজগুলো, রুটিন ওয়ার্ক যাকে বলে, সেটা কিন্তু করতে হবে। তিনি নিজেও নির্বাচনি কাজের জন্য গণভবন ব্যবহার করতে পারবেন না বলেও জানান।

এদিকে আচরণবিধি বলছে, নির্বাচনি প্রচারণায় কোনও রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে ব্যবহার করতে পারবেন না। নির্বাচনি এলাকায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব করতে পারবেন না, কিংবা এ সংক্রান্ত কোনও যোগ দিতে পারবেন না। কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে থাকলে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তিনি বা মনোনীত ব্যক্তি ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভায় অংশগ্রহণসহ কোনও কাজে জড়িত হবেন না। সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তি নিজে প্রার্থী কিংবা অন্য কোনও প্রার্থীর নির্বাচনে এজেন্ট না হলে কেবল ভোট প্রদান ছাড়া ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।

প্রতীক বরাদ্দের দিনেই শুরু হবে প্রচারণা

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ হবে ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হবে। এর আগে কোনও প্রচারণা চালানো যাবে না। তবে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে— প্রতীক বরাদ্দের আগের দিন, অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর থেকেই চাইলে প্রার্থীরা তাদের প্রচারণা শুরু করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে এদিন তারা প্রতীক ছাড়াই প্রচারণার সুযোগ পাবেন।

উল্লেখ্য, আচারণবিধিতে বলা আছে, ‘(১২)ৃ ভোটগ্রহণের নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোনও প্রকার নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করতে পারবেন না। তফসিল অনুযায়ী, ১৭ ডিসেম্বরই তিন সপ্তাহ পূর্ব (৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের দিনের হিসাবে) সময় শুরু হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির উপসচিব আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আচরণবিধিতে যে সুযোগ দেওয়া রয়েছে— প্রার্থীরা তো সেই সুযোগ পাবেন। তবে এক্ষেত্রে প্রচারণা করতে হলে একদিন আগে তাদেরকে প্রতীক ছাড়াই প্রচারণা করতে হবে।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক ইসির অপর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি তারা আগেই বিবেচনায় নিয়েছিলেন। প্রচারণা শুরুর দিন যাতে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া যায়, সেটা ধরেই তারা তফসিলের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।