জেলে থেকে মাছ ব্যবসায়ী, মাসে তিন লাখ আয় কেফায়েতের

প্রকাশিত: ১:৫৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২৪

নোয়াখালী প্রতিবেদকঃ 

জীবনের পাতায় পাতায় সংগ্রাম আর লড়াইয়ের গল্প নোয়াখালীর নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের কেফায়েত হোসেনের। মেঘনার সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় জেলে পেশা দিয়েই শুরু করেছিলেন কর্মজীবন। প্রায় দশ বছর কাজ করেছেন জেলে হিসেবে। নদী-সাগরে মাছ ধরে মজুরি যা পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন। একবার সাত নম্বর বিপদ সংকেতে ট্রলার ডুবে যাওয়ায় সাগরে ভেসে ছিলেন পুরোদিন। সন্ধ্যার দিকে অন্য ট্রলার তাদের উদ্ধার করে কূলে নিয়ে আসে। তারপর জেলে পেশা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন মাছের ব্যবসা। মাত্র দুই হাজার টাকা পুঁজিতে মাছের ব্যবসা শুরু করে এখন কোটিপতি কেফায়েত হোসেন।

জানা গেছে, কেবল কেফায়েত হোসেন নয় নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ জেলে পেশায় জড়িত। জেলে পেশায় নানান ঝুঁকি আছে। তেমনি ঝুঁকি আছে মাছের ব্যবসায়। কেউ কেউ সফল হয়েছেন আবার কেউ কেউ হারিয়েছেন সহায় সম্বল। তবে নিঝুমদ্বীপে সফলতার সংখ্যা বেশি। মাছের ব্যবসা করে কেফায়েত হোসেন প্রতি মাসে তিন লাখ আয় করে হয়েছেন কোটিপতি।

কেফায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দশ বছর জেলে ছিলাম। একদিন সাগরে আমার ট্রলার টা ডুবে যায়। আমি পুরোদিন সাগরে ভেসে ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে একটা ট্রলার আমাদের উদ্ধার করে। তারপরই আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার পুরো শরীর সাদা হয়ে গিয়েছিল। এরপর চিন্তা করলাম উপরে ব্যবসা করব, আর নদীতে যাব না। যেহেতু আমরা মাছ ও নদীর সঙ্গে যোগাযোগ বেশি তাই মাছের ব্যবসা করার পরিকল্পনা করি। আমার কোনো পুজি ছিল না। মনের জোর থেকে ব্যবসা শুরু করি। একজনের কোল্ড স্টোরেজ ১৬ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করলাম। তখন চিংড়ি, বাটা মাছ পেতাম খালি। তারপর দুই মাস ইলিশ ধরা পড়ে। আমার দুই ভাই ছিল ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তখন দুই মাসে ৩৫ লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে। অনেক কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহ সফলতা দিয়েছেন।

কেফায়েত হোসেন আরও বলেন, আমার ট্রলার ডুবে যাওয়ার পর আমার কাছে মাত্র দুই হাজার টাকা ছিল। ১৬ হাজার টাকার ঘর ভাড়া নিতে এই দুই হাজার টাকা জামানত হিসেবে দিয়েছিলাম। আর কোনো টাকা ছিল না। তখন আমার হাতের দুইটা স্বর্ণের আংটি ছিল। আংটি দুইটা ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম।সেই টাকায় মাছ ব্যবসার জন্য ঝুড়ি, বরফ ক্রয় করি। ১০/১২ দিন পর আমার পুঁজির ১২ হাজার টাকা শেষ। আমার ভাগিনাকে দিয়ে এক ঝুড়ি মাছ বিক্রি করতে পাঠালাম সে ৩ হাজার টাকা লস করে দিল। তারপর নদীতে ইলিশ দেখা দেওয়ায় ভাগ্য ফিরতে শুরু করে। আমার দুই ভাইও অনেক পরিশ্রম করেছে। বর্তমানে আমার আট নয়টা ট্রলার আছে। ২০/২৫টা দাদন দেওয়া ট্রলার আছে। একটা রিসোর্ট করেছি ইলিশ মাছের টাকা দিয়ে। বাড়িতে ঘর করেছি। কোনো কোনো মাসে তিন লাখ টাকা, কোনো মাসে এক লাখ টাকা আসে, কোনো মাসে ২০ হাজার টাকা আসে। ইলিশ মাছ পাওয়ার ওপর নির্ভর করে। যখন ইলিশ বেশি পাওয়া যায় তখন লাভ বেশি হয়।

কেফায়েত হোসেন বলেন, নদীর ব্যবসা অনেক কঠিন ব্যবসা। আমি জেলে ছিলাম এজন্য আমি এটা অনুভব করতে পারি। নদীতে গিয়ে আবার ফেরত আসব এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে নিঝুম দ্বীপের মানুষজন নদীর ব্যবসা দিয়েই উন্নত হয়। আর অন্য কিছু আমরা করতে জানি না। আমার লেখাপড়া নেই তাই আমি চাইলে অন্য কোনো ব্যবসা করতে পারি না। নদীর ব্যবসা আমাদের বাপ দাদারা করেছেন আমরাও করতেসি। আল্লাহ যদি তাকায় তাহলে সফলতা আসবে। এই ব্যবসায় সকালে বাদশা সন্ধ্যায় ফকির।

তিনি আরও বলেন, আমি ২০০০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করছি এখন আমার কোটি কোটি টাকার সম্পদ হয়েছে। আমার মা-বাবা আছে এবং আমরা তিন ভাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মা-বাবা যতদিন আছে ততদিন একসঙ্গে থাকার ইচ্ছা। আমি নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের একজন ইউপি সদস্য। আমি কষ্টের মধ্যে বড় হইসি তাই মানুষের কষ্ট সহ্য হয় না। আমাদের নিঝুমদ্বীপে বেড়িবাধ নেই তাই জোয়ার এলে রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যায়। আমি নিজের খরচে সব ঠিক করে দেই। আমার কাছে মানুষের জন্য করতে ভালো লাগে।

মোহাম্মদ ইব্রাহীম নামের নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকে কেফায়েত হোসেনকে আমরা চিনি। তাদের পরিবারের সবাই জেলে পেশার সঙ্গে জড়িত। অনেক চড়াই উৎরাই পার আজ সফল ব্যবসায়ী। আড়তের মালিক হয়েছে। ইউপি সদস্য হয়েছে। সকলের দোয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা তার সফলতা কামনা করছি।

নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের নামার বাজার মসজিদের ইমাম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারিবারিক সমস্যার কারণে ছোটবেলা থেকেই কেফায়েত হোসেনকে কাজে নামতে হয়েছে। এখন ব্যবসা পরিচালনায় সফল। আমাদের ইউনিয়নের সবগুলো ওয়ার্ডের মধ্যে তার ওয়ার্ডের উন্নয়ন অনেক বেশি। সে নিজ থেকেই সব করে।

নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আফসার দিনাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড হাতিয়া, তার থেকেও বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড নিঝুমদ্বীপ। মেঘনা নদী আমাদের চারপাশে হওয়ায় নদীকে কেন্দ্র করে আমাদের জীবনযাত্রা। নদীতে জেলে পেশায় যেমন স্বাবলম্বী হয় আবার নদীতে অনেক জেলে প্রাণ হারায়। কেফায়েত হোসেন আমার ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য। অনেক লড়াই সংগ্রাম করে আজ সে ভালো অবস্থানে আছে। জীবনের সঙ্গে যে যুদ্ধ সে করেছে তা কেউ শুনে অনুভব করতে পারবে না। আমি সব সময় তার সফলতা কামনা করি।

হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলে পেশায় বা মৎস্য পেশায় হাতিয়ার অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছে। ভাগ্য পরিবর্তনের এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। কেফায়েত হোসেন তেমনই একজন। সে এখন অনেকের কাছে উদাহরণ। মাছের ব্যবসায় আকৃষ্ট হলে আমি মনে যারা তরুণ প্রজন্ম যারা শিক্ষিত হয়ে বেকার আছে তারা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারবে এবং ব্যবসার প্রসার হবে।

নোয়াখালী-৬ হাতিয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস বলেন, হাতিয়ার অনেক মানুষ মৎস্যের ওপর নির্ভরশীল। কাজে এই পেশাকে উন্নত করতে পারলে আরও সমৃদ্ধি হবে। প্রধানমন্ত্রী যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রুপান্তর করতে চাচ্ছেন এই মৎস্য ব্যবসার মাধ্যমে আমরা খুব দ্রুতই করতে পারব।