টাইমের প্রতিবেদন: মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের এপিঠ-ওপিঠ

প্রকাশিত: ৭:৫৪ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০২৩

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক সফরে ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তিনি।

টাইম ম্যাগাজিন জানায়, রাষ্ট্রীয় এ সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ও দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়োন সুক ইয়োলের মতো কূটনৈতিক সংবর্ধনা পাওয়ার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি বিবেচিত হবেন তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে।

এর আগে ২০২১ সালে তিন দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন মোদি। তখন বাইডেনের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে মোদির এবারের সফর সর্বোচ্চ কূটনৈতিক পর্যায়ের। এর আগে ভারতীয় কোনো প্রধানমন্ত্রীর এমন আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালে।

ভারত বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর অন্যতম। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ও নতুন আবিষ্কারেও পিছিয়ে নেই দেশটি। বাইডেন প্রশাসন আশা করে, ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করতে পারবে।

হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জ্য পিয়েরে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই সফর দুই দেশের শক্তিকে আরও বাড়াবে।’ তিনি আরও বলেন, উন্মুক্ত আলোচনার সুযোগ ও দুই দেশের উন্নয়নের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ইন্দো-প্যাসিফিকের নিরাপত্তা, কৌশল-প্রযুক্তিগত বন্ধুত্ব, প্রতিরক্ষা, বিশুদ্ধ জ্বালানি এবং মহাকাশ নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।

মোদির রাষ্ট্রীয় সফরে অগ্রাধিকার পাবে যে বিষয়গুলো :

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা এবং উৎপাদন নিয়ে যে সম্পর্ক আছে তা পুনরায় মজবুত করা হবে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ও দিল্লি যৌথভাবে জেট ইঞ্জিন উৎপাদন, দূরপাল্লার কামান ও সামরিক যান নির্মাণে নেমেছে। মে মাসে ভারত বাইডেনের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে যোগ দিয়েছে। কোনো আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য চুক্তি ছাড়াই চীনাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য কমানোর লক্ষ্য নিয়েই এই জোট গঠন করা হয়েছে। আমেরিকার ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’-এর ভারতে সামরিক বিমান উৎপাদনের কথা রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সেমিকন্ডাক্টর এবং চিপ উৎপাদনকারী বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলার প্রয়াস চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, চীনাদের ওপর নির্ভরতা কাটাতেই ভারতে প্রযুক্তি সংক্রান্ত এই বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।

কার্নেজিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান বৈষ্ণব বলেন, ‘চীনা চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে পরিবর্তিত ঘরোয়া ও পররাষ্ট্র নীতিতে অভ্যস্ত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, আপনি যদি সেমিকন্ডাক্টর ও চিপ উৎপাদনের কথা বলতে চান, ভারত এ ক্ষেত্রে বড় খেলোয়াড়।

মোদির প্রতীক্ষিত সফরকে সামনে রেখে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন ও জাতীয় নিরাপত্তা সচিব জ্যাক সুলিভান ইতোমধ্যেই ভারত ভ্রমণ করেছেন। মূলত কথা পাকা হয়ে থাকা চুক্তিগুলোর লাল ফিতা কাটতেই তারা ভারত সফর করেন।

চলতি সপ্তাহে রয়টার্স জানায়, ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে ভারত দুই ডজনের বেশি ড্রোন কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে। সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা ঠেকাতে এই ড্রোনগুলো ব্যবহার করা হবে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে সুলিভানের বৈঠকের পর উচ্চতর প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, পরবর্তী প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে স্বাপ্নিক এক রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়।

বৈষ্ণব বলেন, ভারত আশা করছে আরও মার্কিন ডলার, মার্কিন কোম্পানি তাদের দেশে আসুক। মার্কিন উদ্যোক্তারা ভারতকে তাদের অগ্রগতির কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে বিবেচনা করুক।

কেন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবিলা করতে চায়?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতাপের জন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ স্বার্থে চীনকে মোকাবিলা করতে চায়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের পথে চীনারা বড় বাধা। অন্যদিকে চীনাদের সঙ্গে ভারতের আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের শুরু ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকে।

২০২০ সালে ভূমি নিয়ে চীনাদের আক্রমণাত্মক আচরণ, হিমালয়ের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ও লাদাখে চীনা সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে ২০ ভারতীয় সেনার মৃত্যু, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনাদের গভীর সম্প্রীতি বিষিয়ে তুলেছে দুই দেশের সম্পর্ককে। এ ছাড়া চীন যে দুটি ‘ইকোনমিক করিডর’ পরিকল্পনা করেছে, তার একটি পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভারতের অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষার শক্তি বাড়িয়ে ওয়াশিংটন দিল্লির সাথে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে বলে জানান বৈষ্ণব। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন প্রকৃতপক্ষেই চীনাদের বাধা দিতে চায় এবং এটা বাস্তবায়ন করতে ভারতকে অপরিহার্য এক উপাদান হিসেবেই দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিগত বছরগুলোয় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যহারে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারত রাশিয়ার অনুগামী ছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস, ভারতের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা, ভারতের প্রধান ‘শত্রু’রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দহরম-মহরম দুই দেশকে দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছে।

১৯৯০ সালের আগ পর্যন্তও দুই দেশই বিচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের দেশ ছিল মন্তব্য করেছেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেনিস কুক্স। তবে ২০০০ এর পর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের শক্তিশালী অবস্থানকে স্বীকার করে নিয়ে বিল ক্লিনটন থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করেন।

২০০৫ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক চুক্তির করে। তখন থেকে ভারতকে কার্যত পারমাণবিক শক্তির ধারক রাষ্ট্র বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি কোয়াডে ভারতের অংশগ্রহণ আমেরিকান প্রতিরক্ষা কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যায়। কোয়াড মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর (জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত) একটি জোট।

গত বছর এ দুই পরাশক্তি মিলিতভাবে সামরিক মহড়া চালিয়েছে। মহড়ার জায়গাটি চীন-ভারত সীমান্তের খুব কাছাকাছি ছিল। মে মাসে ভারত বাইডেনের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে যোগ দেওয়ার পর চীনা উৎপাদনের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা কমবে। এগুলোর মধ্যে ভারতকেন্দ্রিক কারখানাগুলো থেকে আইফোনের বাড়তি চালানও রয়েছে।

সূত্র -কালবেলা।