যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি তুহিন পরিচয় লুকিয়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত ছিলেন

প্রকাশিত: ৪:২৭ অপরাহ্ণ, জুন ২৩, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক:

র‍্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশজুড়ে বোমা হামলা মামলায় ঝিনাইদহের যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া জেএমবি সদস্য তুহিন রেজা ঢাকায় একটি টিভি চ্যানেলে কর্মরত ছিলেন। সাজা এড়াতে পরিচয় লুকিয়ে বেসরকারি চ্যানেলটির ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাতে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর এ ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে আসে। সাজাপ্রাপ্ত এ আসামিকে ১৮ বছর পর গ্রেপ্তার করল র‍্যাব।

নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর ৩৪টি স্থানসহ ৪৫০টি স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি।

তিনি বলেন, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ বাদে রাজধানী ঢাকাসহ ৬৩টি জেলা এ হামলা করা হয়। রাজধানীর হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, সচিবালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধাসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় এ বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। আধা ঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এ সিরিজ বোমা হামলায় দুজন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়। একযোগে এ হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছিল জেএমবির সদস্যরা।


র‍্যাব-৩-এর অধিনায়ক আরও বলেন, সিরিজ বোমা হামলায় সারা দেশের মতো ঝিনাইদহ জেলার ডিসি অফিস, জজকোর্ট, পায়রা বন্দরসহ কয়েকটি এলাকায় একই সময়ে একযোগে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ঝিনাইদহ কর্তৃক বিচার শেষে অভিযুক্ত ২১ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হলে আসামিদের সকলকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে আদালত তাদের অভিযোগপত্র পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৪ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয় এবং সাতজন আসামিকে খালাস দেয়।

পরে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা চালানো শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত ১৪ আসামির মধ্যে ১২ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। পলাতক দুজনের মধ্যে ওই মামলার ১০ নম্বর আসামি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে পলাতক জেএমবির সদস্য তুহিন রেজাকে বৃহস্পতিবার রাতে তেজগাঁও রেলগেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৭ নম্বর আসামি মোহন এখনো পলাতক।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি জানান, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ঝিনাইদহ শহরে ডিসি অফিস, জেলা জজ আদালত চত্বর, বাস টার্মিনাল, কলেজ মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে একযোগে বোমা হামলা ও নিষিদ্ধ লিফলেট ছড়ানোর কার্যক্রম চালায় জেএমবি। একযোগে হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির ঘোষণা করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। গ্রেপ্তার তুহিন ২০০৪ সালে জেএমবির ঝিনাইদহ সদর শাখায় সদস্য হিসেবে যোগদান দেন। যোগদানের পর থেকে সে এই শাখার লিফলেট তৈরি, লিখিত প্রচার-প্রচারণার সম্পাদনা, গোপন ও নাশকতমূলক খবরাখবর আদান-প্রদান, বিভিন্ন ভিডিও এডিটিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা বিভ্রান্তিমূলক প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে তরুণদের পথভ্রষ্ট করত।

তিনি বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট হামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ববর্তী দীর্ঘ সময় ধরে তারা হামলার নীলনকশা সাজায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ আগস্ট ভোর থেকেই অন্য হামলাকারীদের সঙ্গে তুহিন আদালত চত্বরের আশপাশে অবস্থান নেয় এবং হামলার সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এলোপাতাড়ি বোমা হামলার পর তারা বিভিন্ন দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তুহিন ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে এসে ঝিনাইদহ সদরে জঙ্গি ক্যাম্পে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে কিছুদিনের মধ্যে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এখানে সে প্রথমে যাত্রাবাড়ী, পরে খিলগাঁও, উত্তরা, মহাখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করে বসবাস করে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে সে বিভিন্ন সময় বাসা পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসবাস শুরু করে। ২০২১ সাল থেকে সে তেজগাঁও এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং সেখান থেকেই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পলাতক অবস্থায় সে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভিডিও এডিটিংসহ বিভিন্ন সফট্ওয়্যার ভিত্তিক কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।