রাজধানীসহ সারাদেশের দোকানপাট ও শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোজার অর্ধেক চলে যাওয়ার পর দোকানপাট ও শপিং মল সীমিত আকারে খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়ায় অনেকটাই বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শপিং মল, মার্কেট, দোকানপাট খুলতে গেলেই সরকারের নির্দেশ সম্বলিত শর্ত মানতে হবে। শর্তের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। অন্য বছরগুলোয় সারারাত মার্কেট খোলা থাকলেও এবছর বিকাল চারটার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বাড়তি পুঁজির। যা অন্য সময় প্রয়োজন হতো না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ মার্কেট, বাজার ও শপিং মলের সামনে-পেছনে প্রশস্ত জায়গা কম। ফলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে যে পরিমাণ স্থানের প্রয়োজন হবে, সে পরিমাণ জায়গা কোনও মার্কেটেই নেই। অপরদিকে ঈদের সময় ক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি মানবেন কিনা তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। ফলে সরকারের দেওয়া শর্ত শতভাগ মেনে মার্কেটও দোকান বা শপিং মল খোলার বিষয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
অপরদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেই কর্মচারীদের বেতন বোনাস দিতে হবে, ঈদের মাত্র ১৫ দিন বাকি থাকতে দোকান বা শপিং মল বা মার্কেট খুললে পর্যাপ্ত বেচাকেনা হবে কি হবে না, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। পর্যাপ্ত বেচাকেনা না হলে কর্মচারীর বেতন বোনাস পরিশোধ করবেন কী দিয়ে? ঈদের সময় ক্রেতার পছন্দসই মালামাল কোথায় পাবেন? কিভাবে আনবেন তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। দোকানের কর্মচারীরাও ঢাকায় নেই। তারা গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দোকানের এসব কর্মচারী কিভাবে কর্মস্থলে ফিরবেন? এসব জটিলতা নিরসনের উপায় নিয়েও চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। ফলে ১০ মে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার কারণে রাজধানীতে জনসমাগম কমে গেছে, অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে গেছেন। যারাও আছেন তারা অনেকেই করোনার ভয়ে মার্কেটে আসবেন না। রাজধানীসহ সারাদেশে অনেকেই বেকার হয়েছেন। দীর্ঘদিন বেকার থাকায় জমানো পুঁজিও শেষ। ঈদের কেনাকাটা করবেন কী দিয়ে? ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রেতা সমাগমও হবে না, বেচাকেনাও হবে না। আর প্রত্যাশা অনুযায়ী বেচাকেনা না হলে মুনাফাও হবে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানীর গাজী সুপার মার্কেটের সভাপতি দিলীপ জানিয়েছেন, এ মার্কেটের একটিমাত্র গেট। এই গেটটি দিয়েই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মার্কেটে প্রবেশ করতে হয়, আবার বেরুতেও হয়। এছাড়া দোকানের যে পজিশন রয়েছে সেখানে একটি দোকানে দুইজনের বেশি ক্রেতার দাঁড়ানোরই তো সুযোগ নাই। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানবো কিভাবে ? সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হবে কী করে? অপরদিকে, ক্রেতারা ঈদের সময় ব্যতিক্রমী পণ্য চাইবেন। তা দিতে না পারলে দোকান খুলে লাভ কী? ঈদের সময় এসব ফ্যাশনেবল পণ্যের সরবরাহ কোথা থেকে আসবে তা আমরা এখনও জানি না।
রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটের সভাপতি বাবু জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (৫ মে) অনেকটাই পরীক্ষামূলকভাবে মার্কেটের দুটো দোকান খোলা হয়েছিল। সারাদিনে কোনও বেচাকেনা হয়নি। কোনও ক্রেতা আসেনি। অপরদিকে দোকান চালানোর মতো কর্মচারীও নাই। পুরোপুরি খোলার পর মার্কেট বা দোকান বা শপিং মল চালানোর মতো কর্মচারী পাবো কোথায়? কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মার্কেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মচারীরা তো বাড়ি চলে গেছে, গণপরিবহনও বন্ধ। তারা আসবে কিভাবে? আর তারা না এলে দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাবো কিভাবে?
রাজধানীর মৌচাক মার্কেটর লাবনী শাড়ি বিতানের মালিক সরোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ঈদের বেচাকেনা তো পুরোদমে শুরু হয় শবে বরাতের পর থেকে। এবছর তো ব্যতিক্রম। শবে বরাত গেছে, রোজারও ১০দিন চলে গেছে। ১০ মে আসতে আসতে ১৫ রোজা চলে যাবে। বাকি ১৫ দিনে কী বেচবো আর কী করবো? ব্যবসা না হলে দোকান খরচ ও কর্মচারীদের বেতন বোনাস দেবো কিভাবে? কর্মচারীরা কাজে যোগ দিয়েই তো বেতন বোনাস চাইবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, সরকারি নির্দেশনা মেনেই আমরা ১০ মে থেকে সীমিত পরিসরে মার্কেট, শপিং মল ও দোকান খুলবো। কিভাবে কী করা যায় তা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করছি। মার্কেটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের বাস্তবতা মানতে হবে। বাস্তবতার বাইরে যাওয়া যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এই তিন জেলা হচ্ছে করোনার হটস্পট। বাস্তবতা মাথায় রেখে এই তিন জেলাকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে। বাকি জেলাগুলোর বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগই যথেষ্ট।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে হেলালউদ্দিন জানিয়েছেন, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দোকানের কর্মচারীদের রাজধানীসহ কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। তা কিভাবে কাটানো যায় তা নিয়েও সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কর্মচারীদের বেতন-বোনাসের বিষয়টি নিয়েও আমাদের মাথাব্যথা রয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি।
উল্লেখ্য, জনগণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও শপিং মল আগামী ১০ মে থেকে চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সোমবার (৪ মে) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পুলিশ প্রশাসনকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে আদেশ জারি করা হয়। নির্দেশনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও শপিং মল খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাগুলো অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট-শপিং মলসহ অন্যান্য কার্যাবলী আগামী ১০ মে থেকে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো। তবে এক্ষেত্রে আন্তঃউপজেলা যোগাযোগ ও চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আদেশে আরও বলা হয়েছে, হাট-বাজার, ব্যবসা কেন্দ্র, দোকানপাট, শপিং মলগুলো সকাল ১০টা থেকে বিকাল চারটার মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি শপিং মলে প্রবেশের ক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘোষিত সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে।
সূত্র-বাংলাট্রিবিউন।