দ্বৈত নাগরিকত্বে ফাঁসছেন দলীয় প্রার্থী

প্রকাশিত: ৫:২৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০২৩

ডেস্ক রিপোর্ট:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৈধ প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের শেষ হয় শনিবার (৯ ডিসেম্বর)। মোট আবেদন পড়েছে ৫৬১টি। রোববার (১০ ডিসেম্বর) শুরু হয়েছে শুনানি। আপিল আবেদনের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, অধিকাংশ আপিলই স্বতন্ত্র প্রার্থীর। তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সংক্রান্ত বিষয়ে গরমিলে। আর দলীয় প্রার্থী যারা আপিল করেছেন তাদের সমস্যা দ্বৈত নাগরিকত্ব।

ইসি সূত্র জানায়, ৫৬১টি আবেদনের মধ্যে ৩২টি আবেদন পড়েছে বৈধ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে। অধিকাংশ বৈধ প্রার্থীর বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ তোলা হয়েছে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে নির্বাচনী এলাকার এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর ও মোবাইল নম্বর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ বিধানেই কপাল পুড়েছে অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থীর।
জানা যায়, প্রার্থিতা বাতিল চাওয়া অধিকাংশ বৈধ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দ্বৈত নাগরিকত্বের। বরিশাল-৪ আসনে (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। তার বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের (বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া) অভিযোগ তুলেছেন এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ দেবনাথ। তার প্রার্থিতা বাতিলও হয়েছে। আর শাম্মী আহমেদের পাল্টা অভিযোগ পঙ্কজ দেবনাথ হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাম্মী আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। সে কাগজপত্র আমার কাছে আছে। আমি ইসিতে এগুলো জমা দেবো। তিনি যদি ইসির আপিলে প্রমাণ করতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক নন, তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই।’

ফরিদপুর-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যবসায়ী আবদুল কাদের আজাদ (এ কে আজাদ) একে অপরের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছেন। এ কে আজাদ আপিল করেন আইনজীবী মো. গোলাম কিবরিয়ার মাধ্যমে। এতে শামীম হকের বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের (নেদারল্যান্ডস) অভিযোগ আনা হয়। একই সঙ্গে এ কে আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর মনোনয়নপত্র বাতিল চেয়ে আপিল করা হয়েছে। আপিল করেছেন ওই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীম। সাদিকের বিরুদ্ধেও দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ আনা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের পক্ষে তার মনোনয়নপত্রের সমর্থনকারী কেবিএস আহমেদ এ আবেদন করেন। আপিলে সাদিক আব্দুল্লাহকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ভোটার হিসেবে উল্লেখ করে সেখানকার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া তথ্যও যুক্ত করা হয়েছে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে বৈধ হওয়ায় দুই প্রার্থীই পরস্পরের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ এনে আলাদা আপিল করেছেন। এছাড়া দিনাজপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বজিৎ কুমার, লালমনিরহাট-১ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত মোতাহার হোসেন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু হাশেম রেজা, ঝালকাঠী-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাজাহান ওমর, ময়মনসিংহ ৯ আসনের আওয়ামী লীগের আব্দুস সালাম, টাঙ্গাইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছোট মনির, নেত্রকোনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাজ্জাদুল হাসান, নোয়াখালী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের একরামুল করিম চৌধুরী ও কুমিল্লা-৪ আসনের আওয়ামী লীগের রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল করা হয়েছে।

ভোটের বিষয়টি গোপনীয়। ভোটার কাকে ভোট দেবেন তা প্রকাশ করা যায় না। অথচ স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য এক শতাংশ ভোটারকে আগেই প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে হবে। এটা কী ধরনের আইন?- স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. গোলাম মোস্তফা

তালিকায় আরও আছেন চাঁদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জালাল আহমেদ, চাঁদপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী মঈন উদ্দিন, চট্টগ্রাম-১০ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম (দুটি আপিল), চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আওয়ামী লীগের আবু রেজা মুহম্মদ নেজামউদ্দিন, চট্টগ্রাম-২ আসনের আওয়ামী লীগের খাদিজাতুল আনোয়ার, চট্টগ্রাম-৯ আসনের আওয়ামী লীগের মহিবুল হাসান চৌধুরী।
এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরের বিধানে ফাঁসছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী

ইসি যে ৭৩১ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে তাদের মধ্যে ১০৫ জন ঋণখেলাপি এবং ১৫ জনের ইউটিলিটি বিল বকেয়া আছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার অন্তত এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন প্রমাণ করতে হয়। এতে ব্যর্থ হওয়ায় নির্বাচন কমিশন প্রায় ৪২৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে। পরে আপিলকারীদের বেশিরভাগই বাদ পড়া এসব স্বতন্ত্র প্রার্থী।

বাদ পড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষোভ
রিটার্নিং কর্মকর্তার যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়া নেত্রকোনা-৫ আসনের প্রার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন নির্বাচন ভবনে আপিল করেছেন প্রার্থিতা ফিরে পেতে। এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরে ত্রুটি দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন।
এ বিষয়ে আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট থেকে দূরে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন দেখানোর আইন করা হয়েছে। এ আইন পরিবর্তন হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতো একজন মানুষের এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন না থাকার অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। এটা গুরুতর বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে এমন পদ্ধতি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য একটা কৌশল। আমি মনে করি আইনটা পরিবর্তন হওয়া উচিত। কেউ যদি না করেন, তাহলে নিজ উদ্যোগে কাজ করবো।’

আমার প্রতিপক্ষের লোকজনের কাছে ওই ভোটার জিম্মি। আগে স্বীকৃতি দিলেও এখন সে অস্বীকার করছে। এ কারণে রিটার্নিং অফিসার আমার মনোনয়ন বাতিল করেছেন। আমার এক ভোট ছিনতাই করে নিয়েছে।- স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুস ইসলাম

ঢাকা-১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসুদ খান বলেন, আমাকে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত সমর্থন তালিকার কারণ দেখিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি তালিকায় আরও বেশি ভোটারের স্বাক্ষর দিয়েছি। আমাকে বলা হয়েছে ১০ জন ভোটারকে তারা যাচাই করেছেন। যার মধ্যে আটজন ভোটার বলেছেন তারা স্বাক্ষর করেননি। তারা আসলেই যাচাই করেছেন কি না, এটা নিয়ে সন্দেহ আছে।

নোয়াখালী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমি এক শতাংশ ভোটার স্বাক্ষর তালিকা প্রস্তুত করার পরও ২৫৫ জন ভোটার বেশি দিয়েছি। রিটার্নিং অফিসের লোকেরা ১০ জন ভোটারের বাড়িতে গিয়েছিল বলে আমাকে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই ভোটাররা নাকি স্বাক্ষর করার কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু ওনারা যে ১০ জনের বাড়িতে গেলেন- এটা কেউ জানেন না। আমাকে যদি বলা হয় আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই ১০ জনকে হাজির করবো। এক শতাংশ ভোটার তালিকা নিয়ে ভাঁওতাবাজি হচ্ছে। এই প্রথা উঠিয়ে দেওয়া উচিত। ভুঁইফোঁড় প্রার্থীরা দলীয় মার্কা নিয়ে ভোট করায় তাদের কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না।’

শরীয়তপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. গোলাম মোস্তফাও একই অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ কিংবা প্রশাসন থেকে ভোটারদের ফোন দেওয়া হলে ভোটারদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। ভোটের বিষয়টি গোপনীয়। ভোটার কাকে ভোট দেবেন তা প্রকাশ করা যায় না। অথচ স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য এক শতাংশ ভোটারকে আগেই প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে হবে। এটা কী ধরনের আইন?

টাঙ্গাইল-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুস ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন অফিস থেকে ১০ জন ভোটারের তদন্ত করতে যায়। গোপালপুরের ৯ জন ভোটারের সবকিছু ঠিক পায়। ভুয়াপুরে একজন ভোটারের বাড়িতে যখন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ সহকারে যান, তখন ওই ভোটার ভয় পান। আমার প্রতিপক্ষের লোকজনের কাছে ওই ভোটার জিম্মি। আগে স্বীকৃতি দিলেও এখন সে অস্বীকার করছে। এ কারণে রিটার্নিং অফিসার আমার মনোনয়ন বাতিল করেছেন। আমার এক ভোট ছিনতাই করে নিয়েছে।’

রোববার (১০ ডিসেম্বর) থেকে আপিল শুনানি শুরু হয়েছে। যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ উঠেছে, তাদের প্রমাণ করতে হবে দ্বৈত নাগরিক নয়। এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে বাতিল হতে পারে প্রার্থিতা।

ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের জানান, শনিবার শেষদিন পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৫৬১টি আপিল আবেদন জমা পড়েছে। আর ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর শুনানি করে আপিল আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করবে নির্বাচন কমিশন। পুরো কমিশন বসেই আপিল নিষ্পত্তি করা হবে প্রার্থীদের উপস্থিতিতে।