নবগঙ্গার গ্রাসে শত ঘরবাড়ি

প্রকাশিত: ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৬, ২০২৪

নড়াইল প্রতিনিধি:

নড়াইলের নবগঙ্গা নদী গ্রাস করছে একের পর এক ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলি জমি। গত এক মাসে কালিয়া উপজেলার বাবলা হাসলা ইউনিয়নের শুক্তগ্রাম, কাঞ্চনপুর, পাটকেলবাড়ি ও হামিদপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে ২৫টি পরিবারের শতাধিক বসতবাড়ি, স্থাপনা, অসংখ্য গাছ ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার, মৃৎশিল্পের সামগ্রী বেচাকেনার প্রসিদ্ধ ৩০০ বছরের পুরোনো শুক্তগ্রাম বাজার এবং কালিয়ার সঙ্গে লোহাগড়া উপজেলার যোগাযোগ স্থাপনকারী বারইপাড়া-মহাজন-লক্ষ্মীপাশা সড়ক। এ সড়কটি নদীতে বিলীন হলে কালিয়া, নড়াইল সদর ও লোহাগড়া উপজেলার হাজারো হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে যাবে এবং ভেসে যাবে কয়েক হাজার মাছের ঘের।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী জানান, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে নবগঙ্গা নদী শুক্তগ্রাম ও পাটকেলবাড়ির বিভিন্ন বাড়ি, গাছগাছালি ও ফসলি জমি ভাঙা শুরু করে। গত দেড় মাসে শুক্তগ্রামের আলেক শেখ, ফুলি বিবি, তবিবুর শেখ, হাসি বেগম, আশরাফ মুক্তার, ইবাদত মিনা, মো. শামসু, তুহিন মিয়া, কালাম শেখ ও আক্তার মোল্যার ৩০টি ঘরবাড়ি ও গাছগাছালি নদী গ্রাস করেছে। এ ছাড়া নদীতে বিলীন হয়েছে পার্শ্ববর্তী কাঞ্চনপুর ও পাটকেলবাড়ির গ্রামের প্রায় ১০ একর ফসলি জমি। এর কয়েক বছর আগে শুক্তগ্রাম বিল এবং শুক্তগ্রাম বাজারের পাশের কুমারপাড়া ও চরপাড়া নদীর পেটে চলে গেছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৩০০ বছরের পুরোনো শুক্তগ্রাম বাজার। এখানে রয়েছে দেড় শতাধিক দোকান, মসজিদ, মন্দির, কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস। বর্তমানে শুক্তগ্রাম বাজার থেকে ভাঙনের দূরত্ব মাত্র আড়াইশ গজ। নদীভাঙন রোধ করতে না পারলে বাজারসহ গ্রামটিই গ্রাস করবে রাক্ষুসী নবগঙ্গা। আর সেই সঙ্গে মানচিত্র থেকে মুছে যাবে শুক্তগ্রামের নাম।
এদিকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি প্রথমে জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে নবগঙ্গা নদী গ্রাস করতে থাকে বিভিন্ন স্থাপনা, গাছগাছালি ও জমি। ইতোমধ্যে বিষ্ণুপুর গ্রামের রিলু ফকির, জনি শেখ, ইমদাদ মাস্টার, মাকসুদ ফকির, মাহাবুর ফকির, রুকি বেগম, রোকেয়া বেগম, মহাদত শেখ, ঝর্ণা বেগম, রিপনা বেগম, কালু সরদার, আল আমিন সরদার, মিল্লাদ সরদার ও শহিদুল মোল্যার অর্ধশতাধিক পাকা-আধা পাকা ও কাঁচা ঘর, গাছপালা, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কিবরিয়া শেখ, বিল্লাল সরদার, পারভেজ সরদার, আরিফ সরদার, খোকন মোল্লা, শাহাদাত সরদার, সাইফুল সরদার, সেতু মোল্লাসহ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে বিষ্ণুপুর ও শুক্তগ্রামের কেউ কেউ রাস্তার পাশে খুপরি ঘর করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবার অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়স্বজন বা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন।
আঙিনার গাছ, সবজি ক্ষেত ও বসতবাড়ি হারিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া ফুলি বেগম ও হাসি বেগম বলেন, আমাদের আর কিছুই নেই, সব নদীতে চলে গেছে। এখন রাস্তা ছাড়া আর কোথাও জায়গা নেই। রাতে ঘুম নেই, ঠিকমতো খাবার নেই। ভাঙনের পর মাত্র পাঁচ কেজি চাল পেয়েছি।
বসতবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত তবিবুর শেখ ও আলেক শেখ বলেন, অনেক কষ্টে বাড়িটা করেছিলাম। এখন মাথা গোঁজার জায়গা নেই। রাস্তার পাশে খুপরি ঘর করে রয়েছি। এখানে স্থায়ীভাবে নদী রক্ষা বাঁধ তৈরি হলে এভাবে প্রতিবছর নদী ভাঙত না।
বিষ্ণুপুর গ্রামের নদীতীরের বাসিন্দা ইমদাদ হোসেন মাস্টার (৭৫) বলেন, জীবনের বেশির ভাগ সময় নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে কেটেছে। এ মাসের প্রথমে চার কক্ষবিশিষ্ট বাড়ি ভিটামাটিসহ নবগঙ্গা নদীতে চলে গেছে। এর আগে দু’বার বাড়ি নির্মাণ করলেও নদী গিলে খেয়েছে। নদীর কাছে বারবার হার মেনে এখন আমি নিঃস্ব। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার মতো এক শতক জমিও অবশিষ্ট নেই। জীবনের বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে, তা আল্লাহ জানেন।
নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন বলেন, জরুরি ভাঙন রোধে বিষ্ণুপুর গ্রামে ২১০ মিটার এলাকায় ৯১ লাখ টাকার জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে এবং শুক্তগ্রামে ২০ লাখ টাকার জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। ভাঙনকবলিত এ এলাকায় স্থায়ী ভাঙন রোধে সার্ভে করে প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলেও ফান্ড না থাকায় এ মুহূর্তে এটা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জাহান সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।