নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ড এখনো স্বজনদের স্মরণে তাজা

প্রকাশিত: ১২:৫১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি:

নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন। ঐতিহ্য আর ব্যবসায়িক কেন্দ্র হলেও এই ঘটনার পর খুনের নগরী হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে নারায়ণগঞ্জ। আজ থেকে ১১ বছর আগে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত সাত খুনের নৃশংস ঘটনা পুরো দেশকে স্তম্ভিত করেছিল। ২০১৭ সালে নিম্ন আদালত ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে। তবে উচ্চ আদালতে আপিল প্রক্রিয়া এখনও চলমান।
দীর্ঘ আট বছর পরও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষায় ঝুলে থাকা চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ কোনো এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে এখনও মামলাটির শুনানি হয়নি। তাই নিম্ন ও উচ্চ আদালতে বিচার সম্পন্ন হওয়ার পরও আসামিদের রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। নিম্ন আদালতে রায়ের পর উচ্চ আদালতে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে, ১১ জনকে যাবজ্জীবন ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।

দীর্ঘ ১১ বছরেও বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানান নিহতদের স্বজনরা। তাদের দাবি সরকারের কাছে আমাদের আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু জীবদ্দশায় সাত খুনের আসামিদের রায় কার্যকর দেখে যেতে চাই। আজ রোববার ২৭ এপ্রিল আলোচিত এ সাত খুন মামলাটির ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে। দ্রুত এ রায় কার্যকর করার দাবিতে নিহতের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী গত শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন পালন করেছেন।জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্করোডের লামাপাড়া এলাকায় র‌্যাব-১১’র তৎকালীন সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদের নির্দেশে কথিত চেকপোস্ট বসিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাচঁজনকে এবং ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালকসহ মোট সাতজনকে অপহরণ করে র‌্যাব সদস্যরা। ওই দিনই সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় ফেলে দেয়। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে নজরুল ইসলামসহ ৬ জন ও পরদিন ১ মে একজনের লাশ ভেসে উঠলে পুলিশ একে একে সাতটি লাশই উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় তখন উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো নারায়ণগঞ্জসহ সমগ্র বাংলাদেশ। পরবর্তীতে র‌্যাব-১১’র লেফটেন্যান্ট কর্ণেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় মামলার প্রধান মাস্টারমাইন্ড নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নুর হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট আসামিদের।

নিহত প্যানের মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় দীর্ঘ আট বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানির জন্য ঝুলে আছে। কেন এই বিচার ঝুলে আছে আমরা তা রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাই। আমাদের দাবি আইন ও বিচার বিভাগের প্রতি ও আইন উপদেষ্টার প্রতি, এই সাতটি পরিবারের দিকে তাকিয়ে এই রায় দ্রুত কার্যকর করুন।

তিনি বলেন, সাত খুনের রায় কার্যকর না হওয়ায় আমরা অনিশ্চিয়তায় ভুগছি। ১১ বছর অনেক মামলারই রায় কার্যকর হয়েছে। সাত খুন মামলাটি একটি আলোচিত মামলা। এ খুনের বিষয়টি সবাই জানেন, সব কিছুই প্রমাণিত, সব কিছুই চোখের দেখা। কেন এ মামলটি এখনো ঝুলে থাকবে? তাহলে বাংলাদেশের আইনের প্রতি কিভাবে আমাদের শ্রদ্ধা থাকবে। আমরাতো আইনের প্রতি আস্থাশীল। এ মামলাটির রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। এই সাতটি পরিবার এ হত্যাকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গেছে। নিহতদের পরিবার অন্তত এইটুকু নিয়ে স্বস্তিতে থাকুক যে, তারা এ হত্যাকাণ্ডটির বিচার পেয়েছে। তারা নির্মমভাবে সাতজনকে হত্যা করেছে। ৭টি পরিবারে যারা মারা গেছেন তারাতো অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। তাদের এ হত্যার বিচার যদি দ্রুত না হয় তবে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি? আমরা চাই যাতে প্রধান উপদেষ্টা আলোচিত এ সাত খুনের মামলাটির দিকে একটু দৃষ্টি দেন। প্রধান উপদেষ্টা যদি সহযোগিতা করেন তবে আশা করি মামলাটি দ্রুত এগিয়ে যাবে।

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী সামছুন নাহার নুপুর বলেন, জাহাঙ্গীর নিহত হওয়ার সময় আমার সন্তান রোজা গর্ভে ছিল। আজ রোজার ১১ বছর চলছে। কিন্তু এখনো আমরা বিচার পাইনি। আমার মেয়ে বাবার আদর সোহাগ বঞ্চিত হয়েছে। আমি সরকারের কাছে দাবি করছি, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে দ্রুত শেষ করে আসামিদের রায় কার্যকর করেন।

নিহত তাজুল ইসলামের ছোট ভাই রাজু আহমেদ বলেন, কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আমার বড় ভাই তাজুল ইসলামসহ নিরীহ সাতজন মানুষকে নূর হোসেনের অবৈধ টাকা কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে র‌্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, কমান্ডার এম এম রানাসহ অন্যান্যরা অপহরণ ও নির্মমভাবে খুন করে। এ হত্যাকাণ্ডের আজ ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে। একটি মামলার সব কিছই প্রমাণ হওয়ার পর ও হাইকোর্টের রায় হওয়ার পরও কোনো অপশক্তি ও অদৃশ্য ছায়ার কারণে এতোদিন আপিল বিভাগে মামলাটি ঝুলে আছে। আমি রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতে মামলার সবকিছু প্রমাণিত হওয়ার পর ও আসামিরা জেলে থাকার পরও আসামিদের ফাঁসির রায় কেন কার্যকর হচ্ছে না।

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, বিগত ১১টি বছর অপেক্ষা করতে করতে আজ আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, এটর্নি জেনারেল এবং প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের আকুল আবেদন এ অপেক্ষার পালা থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। সাত খুনে যে রায় হয়েছে সেই রায়টি দ্রুত কার্যকর করে আমাদেরকে একটু সান্ত্বনার বাণী শোনান। আমরা যাতে একটু সান্ত্বনা পাই।

সাত খুন মামলার নিম্ন আদালতের বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, শুরু থেকেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মামলাটি নিয়ে নানা তালবাহানা করতে থাকে। কিন্তু জনগণের চাপের কারণে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে সাত খুনের মামলাটি দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আসামিপক্ষ সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার পর সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রভাবের কারণে শুনানি হয়নি। যাতে আসামি পক্ষ সুবিধা পায়। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের আমলে এই মামলাটির দ্রুত শুনানি সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানাই। যাতে অপরাধীরা বুঝতে পারে অপরাধী যত বড় প্রভাবশালী হোক না কেন, অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে।

প্রসঙ্গত, আলোচিত এ সাত খুনের মামলাটি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি ৩৫ আসামির মধ্যে সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, অব্যাহতিপ্রাপ্ত র‌্যাব-১১ সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। উচ্চ আদালতে আসামি পক্ষ আপিল করলে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক ৩ কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল ও ১১ জনকে যাবজ্জীবন ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।

আরও উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, নিহত নজরুল ইসলামের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামানের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলামসহ ৬ জন ও পরদিন ১ মে সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন।