নোয়াখালী প্রতিনিধি:
ভয়াবহ বন্যার পর পানি কমতে শুরু করেছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। বানের পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এ অঞ্চলের অন্যতম নাজুক পরিস্থিতি নোয়াখালীতে। বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্র ও ঘরবাড়িতে অবস্থান করা অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগীতে ভরে গেছে হাসপাতালগুলো। মিলছে না প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়েছে দু’জনের।
সরেজমিন নোয়াখালী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে দেখা যায়, ১৬ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী শতাধিক। অন্য ওয়ার্ডগুলোতেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শয্যা, ওষুধ, নার্স ও চিকিৎসক সংকটে রোগীদের অবস্থা কাহিল। চাপ সামাল দিতে চিকিৎসাকর্মীদের ত্রাহি অবস্থা।
হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে দু’দিন ধরে নবজাতক সন্তান নিয়ে আছেন বেগমগঞ্জ উপজেলার বাবুনগর গ্রামের সাজেদা আক্তার-নুর উদ্দিন দম্পতি। তারা জানান, শরীফপুর ইউনিয়ন ও আশপাশের এলাকা ২০ দিন ধরে কোমরসমান পানির নিচে তলিয়ে ছিল। বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে সেখানে ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি পান করেছেন তারা। তা দিয়েই তৈরি করা হয়েছে শিশু খাদ্য। ওই খাবার খেয়ে শিশুর পেটে অসুখ দেখা দেয়। গত বৃহস্পতিবার সকালে পাতলা পায়খানা শুরু হওয়ার পর সন্ধ্যায় অবস্থার অবনতি হয়। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ওয়ার্ডে শয্যা তো দূরের কথা, মেঝেতেও এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। কোনোরকমে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ম্যানেজ করে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসাসেবা চলছে। এরই মধ্যে শুক্রবার কোনো ডাক্তার আসেননি। নার্সই ভরসা।
সদর উপজেলার হেরাঙ্গীর পোল এলাকার বাসিন্দা মানিক মিয়ার মেয়ে আয়েশা আক্তার (২৫) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার সকালে ভর্তি হয়েছেন। সন্ধ্যায়ও দেখা মেলেনি কোনো চিকিৎসকের। হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধও সরবরাহ করা হয়নি। নার্সরা স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছেন, তা দেখে বাইরে থেকে ওষুধ, স্যালাইন, ক্যানুলাসহ যাবতীয় সামগ্রী কিনে আনতে হচ্ছে। নামেই শুধু সরকারি হাসপাতাল। সবই কিনতে হচ্ছে।
নোয়াখালী পৌরসভার লক্ষ্মীনারায়ণপুর মহল্লার বাসিন্দা পারুল আক্তার অভিযোগ করে বলেন, তাঁর শিশু নাতনিকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর শুক্রবার সারাদিন চিকিৎসক তো দূরের কথা, কোনো নার্সকে ডেকে পাননি। রোগীকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
নোয়াখালী সরকারি কলেজের পুরোনো কলেজ ভবন আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা বেগমগঞ্জের অনন্তপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে তীব্র গরম, নোংরা পরিবেশ ও টয়লেট ব্যবহার করে এবং বিশুদ্ধ পানি পান করতে না পেরে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। সেখানে মেডিকেল টিমও কাউকে দেখেনি। কোনো ওষুধও পাননি। হাসপাতালে ভর্তির পরও বাইরে থেকে সব ওষুধ কিনতে হচ্ছে। একই অভিযোগ করেছেন লাকি বেগম, মো. রাজুসহ বেশ কয়েকজন।
ডায়রিয়া ওয়ার্ড ইনচার্জ রাজিয়া সুলতানা রোগীদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শুক্রবার সকালে ১৬ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১২৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর পর থেকে প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। রোগীর চাপে নার্স ও আয়ারা বিপর্যস্ত।
মেডিসিন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. এমরান হোসেন সোহেল বলেন, ডায়ারিয়া রোগীর প্রচণ্ড চাপ। শনিবার (গতকাল) দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন আরও ৯১ রোগী। পাশাপাশি মেডিসিন ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যার বিপরীতে ১৪০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে ডাক্তার, নার্স ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন। জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ, জনবলসহ নানা সামগ্রীর জোগান প্রয়োজন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। প্রয়োজনে আরও কেনা হবে। ডাক্তার ও নার্সদের দায়িত্বে অবহেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নোয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ডায়রিয়া পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। তবে চলতি মাসে বন্যা শুরু হওয়ার পর (৯ থেকে ৩১ আগস্ট) ডায়রিয়ায় কত রোগী আক্রান্ত হয়েছেন, তা তিনি বলতে পারেননি। ডায়রিয়ায় হাসপাতালে দু’জন মারা গেছেন। গত ২৫ আগস্ট বেগমগঞ্জে ১ জন এবং ২১ আগস্ট সদরে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ডায়রিয়া থেকে রক্ষায় ডা. মাসুমের পরামর্শ, বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন খাবার পানি সংগ্রহ করে যেন সরাসরি পান না করেন। পাঁচ লিটার পানিতে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মিশিয়ে ২০ মিনিট রেখে দেওয়ার পর তা পান করলে কোনো সমস্যা নেই। এ ছাড়া খাবার খাওয়ার আগে সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করতে হবে। পাতলা পায়খানা শুরু হলে সঙ্গে আধালিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক প্যাকেট খাবার স্যালাইন মিশিয়ে পান করলে দুর্বলতা অনুভব হবে না। ডায়রিয়া দেখা দেওয়ার সঙ্গে দ্রুত পার্শ্ববর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিংবা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে যেতে হবে।