পানির নিচে যেভাবে দুই ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন সামিয়া

প্রকাশিত: ১১:৪০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০২৩

 

নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুই ঘণ্টা পানির নিচে যেভাবে বেঁচে ছিলেন সামিয়া
বুড়িগঙ্গা নদীর তেলঘাট এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যায় ওয়াটার বাস। ওয়াটার বাসটি ডুবে যাওয়ার সময় কয়েকজন যাত্রী ভেতরে আটকা পড়েন। তারা প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পানির নিচে ওয়াটার বাসের মধ্যে ছিলেন। পরে রাত ৯টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বুড়িগঙ্গার তলদেশে গিয়ে ওয়াটার বাসে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।

একপর্যায়ে রাত ১০টা থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় ৮ জনকে। এদের মধ্যে পাঁচজন জীবিত ও তিনজন হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতরা হলেন- কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার বাবু মিয়ার ছেলে আলিফ (১৪), ঢাকার দোহারের জয়পাড়া এলাকার সবুজের ছেলে ফাহিম (২০) ও লালমনিরহাট জেলার উত্তর সাপটানা এলাকার রউফ শেখের ছেলে নুরুল আফসার (৫২)।

রোববার রাত ৮টার দিকে রাজধানীর শ্যামপুর মসজিদ ঘাট থেকে কেরানীগঞ্জের তেলঘাটে যাওয়ার সময় পোস্তগোলা থেকে আগত একটি বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে ওয়াটার বাসটি ডুবে যায়।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহজামান বলেন, রাতেই উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি রুস্তম বুড়িগঙ্গা নদীতে আসে। পোস্তগোলা সেতুর নিচ দিয়ে এমভি রুস্তম ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে সেতুটি নিচু হওয়ায় আটকে যায়। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ দিয়ে টেনে ধীরে ধীরে ওয়াটার বাসটি তেলঘাট থেকে পোস্তগোলার দিকে নিয়ে যায়। পরে সকালে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ওয়াটার বাসটি পানি থেকে টেনে তোলে।

তিনি জানান, ওয়াটার বাসটি উদ্ধার হলেও নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধান মেলেনি। তাদের সন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা অভিযান চালাচ্ছেন।

ওয়াটার বাসের যাত্রী আলমাস হোসেন বলেন, আমি গুলিস্তান থেকে সদরঘাট আসি। কেরানীগঞ্জে যাওয়ার জন্য বুড়িগঙ্গা পার হতে ওয়াটার বাসে উঠি। ওয়াটার বাসে ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী ছিল। আমি ওপরে ছিলাম বলে সাঁতরে তীরে উঠে যাই। আমার মতো অনেকে সাঁতরে তীরে উঠেছেন।

রোববার রাত ৮টার দিকে রাজধানীর শ্যামপুর মসজিদ ঘাট থেকে কেরানীগঞ্জের তেলঘাটে যাওয়ার সময় পোস্তগোলা থেকে আগত একটি বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে ওয়াটার বাসটি ডুবে যায়। এ সময় অনেক যাত্রী নদীতে ঝাপ দিয়ে প্রাণ বাঁচান। আশপাশে খেয়া নৌকার মাঝি, ট্রলারের মাঝিরা তাদের উদ্ধার করেন। কেউ কেউ সাতরে তীরে উঠে আসেন।

সোমবার বেলা ১১টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে গিয়ে দেখা যায়, নুরুল আফসারের স্ত্রী ও দুই সন্তান কান্না করছে। স্বজনরা জানান, নুরুল আফসার কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জে একটি বোরকার দোকানে বিক্রয়কর্মী ছিলেন। দোকানের পাশে ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। পরে দুপুরের দিকে নুরুল আফসারের লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র দিলে স্বজনরা লাশ নিয়ে রওনা হন।

মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গ সূত্রে জানা যায়, রোববার রাতেই বাকি দুজনের মরদেহ তাদের স্বজনরা নিয়ে গেছে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কাজী মো. রশিদ-উন-নবী উদ্ধার হওয়া জীবিত পাঁচ যাত্রীর মধ্যে তিনজন মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দ্বিতীয়তলায় গিয়ে ওয়াটার বাস ডুবির ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া যাত্রী সামিয়াকে (১৭) পাওয়া যায়।

তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা পানির নিচে ওয়াটার বাসের মধ্যে আটকা পড়ে ছিলেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল পানির তলদেশ থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।

পানির নিচে কিভাবে দুই আড়াই ঘণ্টা ছিলেন? এমন প্রশ্নে সামিয়া বলেন, ওয়াটার বাস ডুবে যাওয়ার সময় উল্টে যায়। পানির স্রোতে সব কিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। হঠাৎ হাত দিয়ে দেখি ওয়াটার বাসের তলা এবং সেখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা যেখানে পানি ঢুকছে না। ওই জায়গায় নাক রেখে কোনোরকম শ্বাস চালিয়ে গেছি। কত সময় কেটে গেছে জানি না। একপর্যায়ে কয়েকজন লোক এসে আমাকে উপরে তুলে নিয়ে আসে। ভাবিও নাই এ ঘটনার পর বেঁচে ফিরব।

সামিয়া এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। কেরানীগঞ্জের মুসলিমনগর বালুরমাঠ এলাকায় তার বাসা। বাবার নাম নূর আলম মুনশি, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে তার ছোট একটা পাঞ্জাবির দোকান আছে।

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের দায়িত্বে থাকা ওয়ারহাউস পরিদর্শক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সাধারণত পানির নিচে পাঁচ মিনিটের মতো বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোনো যান ডুবে গেলে বা উল্টে গেলে বাতাস ঢুকে সেখানে বায়ু প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়। সেই অংশে কেউ থাকলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এখানেও একই ঘটনা ঘটেছে।

নৌ পুলিশের এসপি গৌতম কুমার জানান, ধাক্কা দিয়ে ওয়াটার বাস ডুবিয়ে হতাহতের ঘটনায় দায়ী বাল্কহেড জব্দ ও চালকসহ ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।