নিজস্ব প্রতিবেদক:
সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতকে এগিয়ে নিতে দেশে প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় সময়সীমা ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ৭৩ কোটি ৫৪ লাখ ৭২ হাজার টাকার কার্যক্রম বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে। দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এমন সিদ্ধান্তে হতাশ প্রাণিসম্পদ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি থাকলে তা বন্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে প্রকল্পের কার্যক্রম বাতিল করলে এই খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রকল্পের অনেক কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি দ্য লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এলডিডিপি) বা ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সহায়তাসহ সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। দেশের তিন পার্বত্য জেলা বাদ দিয়ে ৬১ জেলার ৪৬৫ উপজেলায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমান ডলার মূল্যে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৮৯ কোটি ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। ইতোমধ্যে ৭৬ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে প্রায় ৫ হাজার ২৯৪টি খামারি গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৭ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও লাইভস্টক সার্ভিস প্রভাইডারকে (এলএসপি) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে ৩০ থেকে ৪০ খামারি নিয়ে সমিতি গঠন করা হয়েছে।
এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় প্রাণিসম্পদ সেবা বা পশুর চিকিৎসা সুবিধা উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের খামার বা কৃষকের বাড়িতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬০টি গাড়ি কিনে ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিক করা হয়েছে। এসব গাড়ি জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে মনিটর করা হয়। বিশেষ করে পশুসম্পদ খাতকে এগিয়ে নিতে সরকার এককভাবে প্রাণিসম্পদের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এত কিছুর পর প্রকল্পটির কার্যক্রম বাতিল করলে ৪ হাজার ২০০ ইউনিয়ন কর্মী, ৯৪৮ জন মাঠকর্মী, ৪৮৮ কর্মকর্তা এবং ৪৭৫ জন গাড়িচালক বেকার হয়ে যাবেন। এ ছাড়া লাখ লাখ খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
প্রকল্পের যেসব কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ ভবন (সাততলা) ১৫ কোটি টাকা, সাভারে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ডের ভবন (সাততলা) ২০ কোটি টাকা, তিনটি মেট্রো স্লটার হাউস (রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম) ২৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, তিনটি জেলা কসাইখানা ২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা, পাঁচটি কাঁচাবাজার (ওয়েট মার্কেট) ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ডেইরি হাব স্থাপন (পাঁচটি) ১০ কোটি ৫ লাখ টাকা, স্মল স্কেল ফিড মিলার (১১০টি) ২ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রকল্পটির ওপর নজর রাখছিলেন। সম্প্রতি এক বৈঠকে প্রকল্পটির ওই কার্যক্রম বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয় এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত কার্যকরের সুপারিশ করা হয়।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, এই প্রকল্প অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া জরুরি। সামনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করা যেত। কিন্তু তা না করে বিশ্বব্যাংকের টাকা ফেরত দিলে দেশেরই ক্ষতি হবে।
এ বিষয়ে জানতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারকে গতকাল একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে আন্তর্জাতিক দরপত্রের আওতায় অনেক কাজ হাতে নিতে সময় লাগছে। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য প্রকল্পে জরুরি নয় এমন কাজ বাতিল করা হবে।