ফুসফুসের প্রদাহজনিত শ্বাসকষ্ট বাড়ছে শীতে

শিশু ও বয়স্কদের সচেতন থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের ২০২৪ সালে যক্ষ্মা হাসপাতালেই ভর্তি ৪৭৮৩ রোগী

প্রকাশিত: ১২:১৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০২৫

 

 

শীতের এই সময়টাতে শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। যেমন সিওপিডির রোগী বাড়ে। ব্রঙ্কাইটিস রোগী, অ্যাজমার রোগীও এই সময়টাতে বাড়ে। এ সময় রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। উপসর্গগুলো বেড়ে যায়। ঠান্ডা লেগে শিশু ও বয়স্কদের নিউমোনিয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসচেতনতার কারণে মূলত এসব হচ্ছে। আমাদের সচেতন হতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের সময় যে শ্বাসকষ্ট হয় সেটা মূলত ফুসফুসের প্রদাহজনিত কারণে। শ্বাসকষ্ট অনেক কারণে হতে পারে। সেটা বায়ুদূষণের কারণেও বাড়ে। তাছাড়া দিনে দিনে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে ভালো থাকতে হলে নিয়ম মেনে চলতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে ভর্তি আছেন সুমি বেগম (৩২)। পি-১৮ নম্বর বিছানায় বসে সুমি জানান, ‘আমার আগে থেকেই ফুসফুসের সমস্যা ছিল। গত ১০ বছর আগে যক্ষ্মাও হয়েছিল তার। তবে তা নিরাময় হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরের শেষের দিকে রক্তবমি হয়। ফলে দ্রুত হাসপাতালে এসে ভর্তি হন। সেই সময় কথা বলারও শক্তি ছিল না বলে জানান সুমি। তিনি জানান, যখন যক্ষ্মা হয়েছিল, তখন বাবার বাড়িতে ছিলাম, সুস্থ হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি যাই।

নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও লান্স ইনফেকশন নিয়ে ৪ জানুয়ারি থেকে ভর্তি আছেন আফিফা চৌধুরী (২৬)। রাজধানীর বছিলা ঘাটারচর থেকে এসেছেন তিনি। জানান, প্রথমে জ্বর, আর আগে থেকেই ছিল সাইনাসের সমস্যা, ডাস্ট অ্যালার্জির সমস্যা ছিল। আফিফা বলেন, আমার শরীরে কোনো মেডিসিন কাজ করছিল না। বেসরকারি মেডিক্যালে চিকিত্সা করিয়ে এখন পি-২৬ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, আমি মাস্ক ব্যবহার করি, লবণপানি ব্যবহার করি, তার পরেও শীতের শুরুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ি।

কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে ৪০৯ নম্বর রুমে পি-১৭ নম্বর বিছানায় কথা হয় আমির হোসেন (৫৪)-এর সঙ্গে। তিনি ঠিকমতো কথাও বলতে পাচ্ছিলেন না। সঙ্গে থাকা ছেলে শাহীন জানান, ‘বাবার কাশি চার-পাঁচ মাস ধরে, কোনো ওষুধে কমছে না, বরং দিন দিন তা বাড়ছে। শরীরে অস্তিরতা লাগে, হাত-পা ফুলে গেছে, ৯ জানুয়ারি এই হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করাই।’

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট যক্ষ্মা হাসপাতালে গত বছর ২০২৪ সালে মোট ভর্তি রোগী ছিল ৪ হাজার ৭৮৩ জন। এতে দেখা যায়, গত নভেম্বর মাসের চেয়ে ডিসেম্বর মাসে রোগীর সংখ্যা কিছু বেড়েছে। নভেম্বর মাসে ভর্তি রোগী ছিল ৩৮৪ জন, ডিসেম্বরে ভর্তি ছিল ৪২৯ জন, জানুয়ারিতে ৪১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫৪, মার্চে ৪৭২ জন, এপ্রিলে কিছুটা কমে হয় ৩৯০ জন। ২০২৪ সালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ২৮০১ জন ছিল পুরুষ রোগী, ১৯২২ জন ছিল নারী রোগী এবং ৬০ জন ছিল শিশু। ২০২৩ সালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৭১৪ জন, নারী ১৭৬৮ জন এবং শিশু ছিল ৮৬ জন।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট যক্ষ্মা হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার ইত্তেফাককে বলেন, শ্বাসতন্ত্রের রোগের বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে। সঙ্গে যক্ষ্মা তো আছেই। হাতের নখ ও চুল ছাড়া বাকি শরীরের অন্য যে কোনো জায়গায় যক্ষ্মা হতে পারে। আমাদের দেশে অ্যাজমা ও সিওপিডি রোগীর সংখ্যা বেশি। অ্যাজমার ক্ষেত্রে রোগী শ্বাসকস্ট নিয়ে আসে। সিওপিডির ক্ষেত্রে কাশি হয়। শ্বাসকষ্ট অনেক পরে হয়। এই শীতে শ্বাসকষ্টের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যেমন তীব্র শীতে শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়ে। বিভিন্ন অঙ্গ ফেইলিউরের কারণেও শ্বাসকষ্ট হয়। এই শীতে ঠান্ডা, কাশি, সর্দিজ্বর হতে পারে। সেটা বায়ুদূষণের কারণেও বাড়ে। তাছাড়া দিনে দিনে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে নিয়ম মেনে চলতে হবে। লাইফস্টাইল বদলাতে হবে। ফামের্সি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া এসব বন্ধ করতে হবে। সঠিক সময় এবং শুরুতে চিকিত্সা নিলে সহজে সারা জীবন ভালো থাকা যায়। অসচেতনতার কারণে মূলত এসব হচ্ছে। আমাদের সচেতন হতে হবে। এখন রোগী বাড়ছে। এ কারণে মানুষ সচেতন হচ্ছে। প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ঠান্ডা লেগে শিশু ও বয়স্কদের নিউমোনিয়া হয়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঋতু পরিবর্তনের সময়টাতে বেশি হয় এসব সমস্যা।

রাজধানী শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ কে এম ফাহমিদ নোমান ইত্তেফাককে বলেন, শীতের শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেও ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। আমের মুকুল এলে এগুলো বাতাসে শ্বাসনালিতে যায়। এতে অ্যালার্জি বেড়ে যায়, বিশেষ করে সিওপিডি ও অ্যাজমা রোগীদের সমস্যা হয়। আর ঠান্ডায় নিউমোনিয়া বাড়ে, যারা ধূমপায়ী অথবা শিশুদের ক্ষেত্রেও এটা বেশি হয়। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন ডায়াবেটিসের রোগী। এরা নিউমোনিয়া হওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিকারে এই চিকিত্সক বলেন, প্রচণ্ড শীত থেকে দূরে থাকতে হবে। বাসায় যেন বাতাস চলাচল হয়, ফ্লুর ভ্যাকসিন নিতে হবে। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, অনেকের ফুড অ্যালার্জি থাকে, এসব পরিহার করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো নিজেকে ভালো রাখার ইচ্ছা থাকতে হবে।