বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কত দূর গড়াবে?

প্রকাশিত: ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

৫ আগস্ট ২০২৪-এ ১৫ বছরের আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন একটি প্রশ্ন সর্বত্র ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। তা হলো, দুই পরাশক্তি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দ্বৈরথে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে।পুলিশি তাণ্ডবে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বোঝা গিয়েছিল অবাধ নির্বাচন আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অতঃপর ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনে শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদের ক্ষমতার গদিতে বসে যান। অবশেষে নিরুপায় বাইডেন প্রশাসন নির্বাচনের একমাস পূর্ণ না হতেই স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সাথে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করে ৪ ফেব্রুয়ারি বিবৃতি জারি করে।

বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ বছরের নীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশটি ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে। অতঃপর ২০২২-২০২৩ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র হাসিনার স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতায় বহাল থাকার বিরোধিতা করেছে। পরে ব্যর্থ হয়ে আবার হাসিনাকেই মেনে নিয়েছে।

৫ আগস্ট অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে যুক্তরাষ্ট্র কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ নবগঠিত ইউনূস সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। এতে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের একত্রে পথ চলার দীর্ঘ ২০ বছরের পুরোনো সম্পর্কের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তবে ভারত হাল ছেড়ে না দিয়ে এখনো সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ব্যাকুল হয়ে আছে।

বাইডেন প্রশাসনের ডোনাল্ড ল্যু ও জ্যাক সুলিভানের ভারত সফরকে ঘিরে এমন এক আবহ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল যাতে মনে হবে বাংলাদেশ প্রশ্নে মোদি-জয়শঙ্করের কথা শুনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু একটা করতে চলেছে। এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘিরেও ভারত একই আবহ তৈরির চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। খুব সহজেই অনুমান করা যায়, আগামীতে যখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটবে তখনই ভারতীয় পক্ষ থেকে সেই আবহ তৈরির প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকবে।

চীনের বৈদেশিক নীতি মার্কিন নীতির বিপরীত। চীনা পররাষ্ট্র নীতির বৈশিষ্ট্য হলো, চীন অপর দেশের যেকোনো সরকারের সাথে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। সরকারের ধরন উদার গণতান্ত্রিক নাকি কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক তা বিবেচনায় রাখে না। এমনকি কোনো স্বৈরাচার অখুশি হতে পারে সে ধরনের বিবৃতি প্রদান করা থেকে চীন বিরত থাকে এবং স্বৈরাচারের প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দলের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে চলে।

ইদানীং ক্ষেত্র বিশেষে চীনা এই পররাষ্ট্র নীতির কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন চীন এখন মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সমঝোতার তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। ইতিপূর্বে ২০২৩ সালে ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কন্নোয়নে চীন মধ্যস্থতা করেছে। ২০১৭ সালে চীন জিবুতিতে নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে, যা ছিল দেশের বাইরে তার প্রথম সামরিক ঘাঁটি।

এছাড়া সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানের ক্ষেত্রে চীন তার দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষ নীতি ত্যাগ করে ভেটো প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রাখছে। চীনের এসব কর্মকাণ্ড দেশটির বৈদেশিক নীতি পরিবর্তনের আভাস দেয়।

সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাথে নিয়ে চীন বিরোধী কোয়াড ও ইন্দো প্যাসিফিক জোট গঠন করেছে। তবে এই দুই জোটের এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকলেও চীনকে মোকাবিলার অভিপ্রায় থেকেই তা গঠিত হয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট অবস্থান থাকা সত্ত্বেও ১৫ বছরে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এগিয়ে গিয়েছে। হাসিনা আমলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত ঋণ প্রদান বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের সাথে চীনের এই ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র রোধ করতে পারেনি। এর কারণ বাংলাদেশের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের আর্থিক সক্ষমতা বেশি। আর্থিক সক্ষমতার প্রশ্নে ভারতের সাথে চীনের তুলনাই চলে না। বরং ভারত নিজেই এখন আরও অধিক হারে চীনা ঋণ পেতে মুখিয়ে আছে। যদিও নরেন্দ্র মোদির সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তা আড়াল করে রাখে।

এককালে চীন-ভারত শক্তিমত্তার তুলনাসূচক তর্কে উভয়ের সমকক্ষ হওয়ার ধারণা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতকে যদি হাতি ধরা হয়, তবে চীনকে বলা চলে তিমি। এমনকি চীন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অগ্রগামী। উদ্বৃত্ত অর্থ কিংবা সঞ্চয়ের পরিমাণ, অবকাঠামোগত প্রকল্পে ঋণ দান, নগদ অর্থ সহায়তা, ঋণ কিংবা সুদ মওকুফ, সুদ হার কমানো, সুদ ফেরত দানের কিস্তির সময়সীমা পুনঃনির্ধারণ ও বিলম্বিতকরণ এসব আর্থিক সক্ষমতায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে।

বাংলাদেশের প্রয়োজন পূরণে চীনের এই সামর্থ্যকে শেখ হাসিনা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই এ বিষয়টি না দেখার ভান করে তাতে নীরবে সায় দিয়ে দিয়েছে।

৫ আগস্ট হাসিনার পতন হওয়া মাত্রই চীন নবগঠিত ইউনুস সরকারের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের পর ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশ ঘুরে যায়। হাসিনার পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ হাসিনা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করতে থাকে।

৭ নভেম্বর চীনের আমন্ত্রণে বিএনপির ৪ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধি দল বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ‘পলিটিক্যাল পার্টি প্লাস’ কো-অপারেশন সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। চীনের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় লক্ষণ হলো, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ২০ জানুয়ারি ২০২৫ চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার এই সফরকে আগামী মার্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরের প্রাক প্রস্তুতি বলা চলে। এখন প্রশ্ন হলো, চীনের সাথে বাংলাদেশের এই ঘনিষ্ঠতাকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখবে? অর্থাৎ চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কত দূর পর্যন্ত গড়াতে পারবে?

১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ধারণা করা হচ্ছিলো, দুনিয়া জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ও নেতৃত্ব আরও বহুকাল বিনা বাধায় চলতে থাকবে। সে সময় বলা হতে থাকে নতুন আমেরিকান শতাব্দী (ঘবি অসবৎরপধহ ঈবহঃঁৎু) শুরু হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কবলে পড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহসাই উপলব্ধি করে চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি ভয়েস অফ আমেরিকা (ভোয়া) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয় ঈযরহবংব ঊপড়হড়সু ঈড়ঁষফ ঙাবৎঃধশব টঝ ঊপড়হড়সু নু ২০৩০। অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যেই চীনা অর্থনীতি মার্কিন অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে চীনের অর্থনীতি ১৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, আর ওই বছর মার্কিন অর্থনীতির পরিমাণ ছিল ২৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চীনের বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি শতকরা ৪.৭ শতাংশ হারে চলতে থাকলেই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে স্থানচ্যুত করে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনা অর্থনীতির এই উত্থান ঠেকাতে ভীষণ তৎপর হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ (ঊপড়হড়সরপ ঘধঃরড়হধষরংস) প্রবর্তন করতে চলেছেন তা চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এই দ্বৈরথে চীনের উত্থান সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে অথবা চীন পরাজিত হয়ে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন থাকতে পারে।

তবে পালাবদল যুগের এ সংঘাত বিশ্ব ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড নাড়া দেবে। আর যেহেতু এই পালাবদলের সংঘাতের ভরকেন্দ্র এশিয়া, তাই এ অঞ্চলের দেশগুলোর রাজনীতি ও অর্থনীতির পূর্বের অবস্থানগত সমীকরণ এলোমেলো হতে থাকবে সবার আগে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের কৌশল হওয়া উচিত বলয়কেন্দ্রিক রাজনীতি পরিহার করা।

চীনপন্থী কিংবা মার্কিনপন্থী হয়ে পড়া বাংলাদেশের জন্য আদৌ মঙ্গলজনক নয়। বাংলাদেশের জন্য উত্তম পন্থা হলো, স্বদেশ ভাবনায় বিভোর থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া।

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমকে বিচলিত করে তোলার কারণ নেই। কেননা অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হলে এদেশে পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগের পথকে সুগম ও নিষ্কণ্টক করে তুলবে না। ভঙ্গুর অবকাঠামো বিনিয়োগ পরিবেশের সবচেয়ে বড় বাধা।

অতএব বাংলাদেশ চীনা ঋণ গ্রহণ করে এবং একই সাথে মার্কিন ও পাশ্চাত্য দেশের এফডিআইকে (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) সুযোগ দান করে উভয় কূল রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা চুক্তি (টিকফা) এগিয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট রাখতে পারে।

বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি না পেলে এদেশে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা পণ্যের ক্রেতা তৈরি হতে পারবে না। তাই চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ঋণ কিংবা নগদ অর্থ সহায়তা গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে না। সুতরাং এভাবে চীন-মার্কিন দ্বৈরথে ভারসাম্যমূলক নীতি বজায় রাখার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।

এককালে মার্কিন কিংবা সোভিয়েত বলয়ের বাইরের অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশসমূহকে তৃতীয় বিশ্ব বলে ডাকা হতো। বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের স্থলে চীনের মুখে গ্লোবাল সাউথ নামটি প্রায়শই উচ্চারিত হচ্ছে। চীনের নেতৃত্বে গঠিত ব্রিকস জোট আইএমএফের আদলে আলাদা একটি ঋণদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়তে চায়।

এছাড়া ব্রিকস আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের একমাত্র বিনিময় মুদ্রা মার্কিন ডলারকে সরিয়ে দিয়ে নতুন মুদ্রা চালু করতে চায়। ব্রিকসের মর্ম কথায় বলা হচ্ছে, সংস্থাটি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সাথে উইন-উইন বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করবে। এভাবে চীন নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু চীন কিভাবে এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবে তা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

বিশ্ব নেতা হওয়া শুধু আর্থিক সক্ষমতা ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ওপর নির্ভর করে না। বিশ্ব নেতা হতে চাইলে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা, আন্তর্জাতিক বিচার কাঠামো প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা ও নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববাসীর সামনে চীন এখনো এসব বিষয়গুলো তুলে ধরেনি।

সন্দেহ নেই, বর্তমান দুনিয়ায় ভূ-রাজনীতির চেয়ে ভূ-অর্থনীতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের আর্থিক সক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব অপর দেশের ওপর ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার যেসব কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহ তৈরি করেছে তার বিকল্প ধারণা ও ব্যবস্থা চীন উপস্থাপন করতে পারেনি। এটাই চীনের বিশ্ব নেতা হওয়ার প্রধানতম অন্তরায়।

যুক্তরাষ্ট্র আরও দীর্ঘকাল বিশ্বনেতা হিসেবে টিকে থাকবে কিনা অথবা চীন তাকে টপকে যাবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত হুট করে দৃশ্যমান হবে না। এ লড়াই দীর্ঘ কয়েক দশক পর্যন্ত চলতে পারে। বস্তুত পরিবর্তনের গতিরোধ করার কর্তৃত্ব কারও একক ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং তা প্রাকৃতিক ঘটনার মতোই কারো কর্তৃত্ব ছাড়াই সংঘটিত হয়ে যায়।

চীন বিনা বাধায় একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনা উত্থান ঠেকানোর তৎপরতার অভিঘাত অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও রাজনৈতিক উত্তেজনা-অস্থিরতা তৈরি করবে। সেই চাপ মোকাবিলায় কীভাবে ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণের কৌশল অবলম্বন করা যায় সেজন্য জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্র স্বার্থ রক্ষা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।

বাংলাদেশ রয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ঝুঁকিতে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের আতঙ্ক থেকেই এদেশের জনমত চীনের সাথে সখ্যতা গড়তে আগ্রহী। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারলে চীন-বাংলাদেশ আরও গভীর সম্পর্ক তৈরি হতে পারবে।

অন্যদিকে চীন-মার্কিন দ্বৈরথে বাংলাদেশ শামিল না হয়ে বরং চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতা নিরসনে বাংলাদেশ সেতু বন্ধনের ভূমিকা পালন করতে পারে। এদেশ হতে পারে পূর্ব-পশ্চিমের বিরোধ মীমাংসার নিরপেক্ষ কেন্দ্রভূমি। ঢাকা হতে পারে শান্তি সংলাপের কেন্দ্রস্থল। তবে এর জন্য এদেশে প্রয়োজন উপযুক্ত নেতৃত্ব ও যথাযথ কর্মকৌশল।