জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক:
রেফারি–আম্পায়ারদের কাজ ‘থ্যাংঙ্কসলেস জব’। ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনে আম্পায়ার/রেফারির সিদ্ধান্ত না মানা, গালমন্দ এমনকি লাঞ্চিতের ঘটনাও অনেক। ফুটবল রেফারিং এবং ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ে সম্মানী ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার পরিধি বেশি। সেই তুলনায় হকিতে সুযোগ-সুবিধা কম। এরপরও একই পরিবার থেকে বাবার পর ছেলে এবং ছেলের স্ত্রীও (পুত্রবধূ) এসেছেন হকি আম্পায়ারিংয়ে।
সাবেক হকি খেলোয়াড় আব্দুর রশিদ খান (সোলায়মান) নব্বই দশক থেকে আম্পায়ারিং করেন। তার ছেলে মুহাম্মদ আলী খান (পিয়াল) আম্পায়ারিং শুরু করেন ২০১৬ থেকে। শ্বশুর এবং স্বামীকে অনুসরণ করে আম্পায়ারিংয়ের বাঁশি হাতে তুলে নিয়েছেন জেসমিন আরাফাত জেসি। একই পরিবারের তিনজন আম্পায়ারিংয়ে আসার ঘটনা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নেই বলেই জানিয়েছেন সোলায়মান, ‘হকিতে এমন আর কোনো পরিবার নেই। ক্রিকেটে ওসমান খানের বাবা চান খান ছিলেন কোচ। বাবা-ছেলে আম্পায়ার, রেফারি– এমন কাউকে চোখে পড়ে না। তেমনি স্বামী-স্ত্রীও।’
সাবেক আন্তর্জাতিক আম্পায়ার ও বাংলাদেশ আম্পায়ার্স এন্ড স্কোরার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সায়লাব হোসেন টুটুলের বাবা নূর হোসেন রেফারি ছিলেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ের সঙ্গে থাকা টুটুলও স্মরণ করতে পারেননি বাবা-ছেলে বা স্বামী-স্ত্রীর আম্পায়ারিংয়ের কীর্তি, ‘শীর্ষ পর্যায়ে বাবা-ছেলে আম্পায়ারিং করেছে এমন ঘটনা মনে পড়ে না। জেলা-স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকজন থাকতে পারে।’ দেশের সাবেক ফিফা রেফারি তৈয়ব হাসানও রেফারিং অঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ে এমন কাউকে পাননি।
আশি-নব্বইয়ের দশকে খেলার মান ও জনপ্রিয়তায় ফুটবলের পরেই ছিল হকি। সেই হকি এখন নানা সমস্যাসহ ভাবমূর্তির সংকটে। বিশেষ করে ঘরোয়া হকি লিগ মানেই আম্পায়ারিং বিতর্ক। পুরুষ আম্পায়ারদের যখন ভীতিকর অবস্থা, সেখানে নারীদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। নারী হকির চর্চা বাংলাদেশে কম এবং নারী আম্পায়ার একেবারেই অপ্রতুল। এরপরও নারী আম্পায়ারিংয়ে আসার কারণ সম্পর্কে জেসি বলেন, ‘আম্পায়াররাই মূলত সকল নিয়ম কানুন ভালো জানেন। হকি খেলোয়াড় হিসেবে আম্পায়ারিং জ্ঞান থাকা উচিৎ বলে মনে করি। আম্পায়ারিং জানা থাকলে কোচিংও করা যায়।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আম্পায়ারিং সম্মানীয় বিষয় হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আম্পায়াররা অবহেলিত নানাভাবে। অনেক সময় গ্যালারি থেকে গালমন্দ করা হয়। নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আম্পায়ারিংয়ে আসার আগে আমিও ভাবতাম আমার স্বামীর ওই সিদ্ধান্ত ভুল, ওটা সঠিক ছিল না। কিন্তু আম্পায়ারিংয়ে এসে বুঝলাম দর্শক বা খেলোয়াড়রা নয়, আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। যারা জানে না তাদের সমালোচনা নেওয়ার কোনো কারণ নেই।’
জেসি জাতীয় পর্যায়ে এখনও আম্পায়ারিং শুরু করেননি। হকি আম্পায়ারিংয়ে তিনি বি-কোর্সের সনদ পেয়েছেন। স্বামীর চাকরি সূত্রে কক্সবাজারে থাকায় নানা হকি টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করছেন সেখানেই। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং কোর্সও করেছেন। তাই আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হওয়ারও স্বপ্ন তার, ‘আমার শ্বশুরের ইচ্ছে ছিল আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হওয়ার, শেষ পর্যন্ত পারেননি। আমার স্বামী আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হওয়ার পথে। আমিও হতে চাই আন্তর্জাতিক আম্পায়ার।’ আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হতে ফিটনেস, ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতাসহ আরও নানা বিষয় রয়েছে। পড়াশোনা ও সংসার সামলে হকির আম্পায়ারিংয়ের স্বপ্ন পূরণের বিষয়ে তিনি জানান, ‘আমার পরিবার থেকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট রয়েছে। পড়াশোনা ও সংসারের পাশাপাশি তাই হকিতেও আছি। আমি এখনও খেলছি, তবে স্বপ্নটা আম্পায়ারিং নিয়েই বেশি।’
সাবেক হকি খেলোয়াড় আব্দুর রশিদ খান সোলায়মান নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আম্পায়ারিং শুরু করেন। দুই যুগ আম্পায়ারিংয়ের পর এখন জাজ হিসেবে কাজ করছেন। ছেলে ও পুত্রবধূর আম্পায়ারিং সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ, ‘আমার ছেলে পিয়াল সেও হকি খেলত। ইনজুরির পর চিন্তা করল আম্পায়ারিং করবে। আমি আম্পায়ার ছিলাম, তাই ছেলের আগ্রহে সায় দিলাম। জেসিও হকি খেলোয়াড়। হকির মাধ্যমে ওর সঙ্গে পিয়ালের সম্পর্ক। আমাদের হকি পরিবারে এসে জেসিও আম্পায়ারিংয়ে আগ্রহী হয়েছে। নারীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো করার সুযোগ ও সম্ভাবনা বেশি। জেসি লেগে থাকলে অবশ্যই ভালো আম্পায়ার হবে।’
সোলায়মান এখন আম্পায়ার্স বোর্ডের সেক্রেটারি। লিগ ম্যাচগুলোতে কোন ম্যাচে কোন আম্পায়ার এই মনোনয়ন দেয় আম্পায়ার্স বোর্ড। নিজে কমিটির বড় পদে থাকলেও ছেলের ব্যাপারে খুব নিরপক্ষে অবস্থানে সোলায়মান, ‘আমি আম্পায়ার্স বোর্ডে থেকে কখনও আমার ছেলের নাম প্রস্তাব করি না। অন্য দুই সদস্য নাজু এবং মাকসুদ ভাই আমার ছেলের ম্যাচ বরাদ্দ করে। আমি শুধু বলি আপনারা সঠিক মনে করলে দিতে পারেন।’
নব্বইয়ের দশকে সোলায়মানের আম্পায়ারিংয়ে শুরুটা বেশ নাটকীয়। পরীক্ষায় পাশ করেও দুই বছর বসে ছিলেন ম্যাচ পরিচালনা ছাড়াই। এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের দিন আসলাম বেলিম আকস্মিকভাবে আহত হন। তখনই সোলায়মানের ডাক পড়ে। এরপর আর থামেননি তিনি। ‘ঘটনাচক্রে লিগে বড় ম্যাচ দিয়েই আমার শুরু হয়েছে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অনেক বড় বড় ম্যাচই করেছি, আন্তর্জাতিক ম্যাচ/টুর্নামেন্ট করলেও আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হতে পারিনি। এই আক্ষেপ রয়েছেই’, জানালেন সোলায়মান।
সোলায়মানের অপূর্ণতা অনেকটা পূরণের পথে তার ছেলে মুহাম্মদ আলী খান পিয়াল। এবারের লিগে বেশ কয়েকটি ম্যাচে তিনি বাঁশি বাজিয়েছেন। আট বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পিয়াল তার ক্যারিয়ারে বড় দলের ম্যাচও পরিচালনা করেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশের। বাবার স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হওয়ার বেশ কাছাকাছি আছি। বাবা চেষ্টা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত হয়নি। আমি হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমার স্ত্রীর আগ্রহ রয়েছে, আশা করি সেও আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হবে।’
তিন যুগ হকির আম্পায়ারিংয়ের সঙ্গে সোলায়মান। আগের তুলনায় এখন আম্পায়ারিংয়ের মান বেড়েছে বলেই পর্যবেক্ষণ তার, ‘আম্পায়ারিং এখন আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর। আমাদের আম্পায়াররাও শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের আম্পায়ারদের সংখ্যা বাড়বে।’