বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের না হলে তথ্য দেবে না জাতিসংঘ

প্রকাশিত: ২:৪৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

আওয়ামী লীগ সরকার জনতার প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে পরিকল্পিত ও সমন্বিত কৌশলের মাধ্যমে নৃশংসতা চালিয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশেই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছে। বুধবার দুপুরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রোরি মুনগোভেন ও দপ্তরের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি।

এক প্রশ্নের জবাবে রোরি মুনগোভেন বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না করলে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের কাছে দেওয়া হবে না। প্রতিবেদনে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়নি। তবে আমরা প্রচুর তথ্য সংরক্ষণ করেছি। সর্বোচ্চ মান অনুযায়ী এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যাতে পরে ব্যবহার করা যায়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করার বিষয়ে রোরি মুনগোভেন বলেন, জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি আমাদের জন্য একটি সমস্যা। আমরা এমন বিচারে সহযোগিতা করতে পারি না যেটা মৃত্যুদণ্ডের দিকে নিয়ে যায়। তবে বিচার প্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলার বিষয়ে জোর দেন তিনি।

মুনগোভেন বলেন, আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে। কারণ, এটি প্রতিশোধের একটি স্থায়ী চক্র তৈরি করে দেয়। মৃত্যুদণ্ড বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে থাকা অপরাধীর প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অনেক সদস্য রাষ্ট্রের জন্য প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে সহযোগিতায় মৃত্যুদণ্ড একটি প্রতিবন্ধকতা।

মানবাধিকার লঙ্ঘনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ভলকার টুর্ক বলেন, প্রতিবেদনে এটি স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ মহল বিষয়টি সম্পর্কে জানত। প্রকৃতপক্ষে গুম, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, সহিংস পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দমনের মতো নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল।

মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত শেখ হাসিনা এখন ভারতে আছেন। এ ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে– জানতে চাইলে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার বলেন, যদি অপরাধী দেশের বাইরে থাকে, তখন ‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন’ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যে দেশে অপরাধী অবস্থান করছে, তাদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধের বিচার করতে সম্মত হতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) এ বিষয়ে তদন্তের জন্য বলতে পারে।

তবে তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আইসিসিতে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

তার মতে, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার কাজ শুরু হয়েছে; অনেক মামলাও হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে এবং এটিকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ।

গতকাল জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় জানায়, প্রতিবেদন অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ছিল। বিক্ষোভকারীকে সহিংসভাবে দমন করা ছিল সরকারি নীতি। এগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে আরও তদন্তের মাধ্যমে ফৌজদারি ব্যবস্থার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে হতাহত হয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী নিহতের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ দাবি করেছে, তাদের ৪৪ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।

আন্দোলনের শুরুটা ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে। তবে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে ছিল সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ। প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার বিক্ষোভ দমনে সহিংস পথ বেছে নিয়েছিল।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, আমরা যে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেয়েছি, তাতে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং টার্গেট কিলিংয়ের এক উদ্বেগজনক চিত্র উঠে আসে। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও আন্তর্জাতিক অপরাধ।

সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সূত্র জানায়, কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য কর্মকর্তারা অভিযানের নির্দেশনা ও তদারকি করেন। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীর ওপর নির্বিচারে গুলি ও নির্যাতন করেছিল। এমন ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে আন্দোলনকারীর ওপর একদম কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে।

৫ আগস্ট ছিল বিক্ষোভের শেষ ও সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনের একটি। আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে জানিয়েছে, পুলিশ সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। সে অন্তত এক ডজন লাশ দেখতে পেয়েছিল।

প্রতিবেদনে এমন ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী আহত বিক্ষোভকারীকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতেও বাধা দিয়েছে। সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, হাসপাতাল থেকে তাদের আঙুলের ছাপ নিয়েছে, চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত কর্মীদের ভয় দেখিয়েছে, হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করেছে।

প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। যেমন নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্ন মতকে দমিয়ে রাখার জন্য যে দমনমূলক আইন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তা বিলুপ্ত করা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা।

মানবাধিকার হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ হলো– গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা যাতে আর কখনও না ঘটে তা নিশ্চিত করা।