ডেস্ক রিপোর্ট :
ব্রিটিশ ভারতবর্ষে মুসলিম ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠার পরও নারী শিক্ষার যুক্তি দেখিয়েছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার লেখা পড়ে নারীরা আজও আলোড়িত হন। আন্দোলিত হন নতুন প্রাণে, নতুনভাবে বেঁচে থাকার জন্য। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, পুরুষতান্ত্রিকতার শেকল ভাঙার মানসে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অবিস্মরণীয় এক নাম।
রংপুরের মিঠাপুকুরে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে ১৮৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের ও মা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। তার পারিবারিক নাম-রোকেয়া খাতুন। অনেকে আবার তাকে ‘বেগম রোকেয়া’ নামেও চেনেন। তখনকার ভারতবর্ষে মুসলিম নারীদের উর্দু-ফারসি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার সুযোগ ছিল না। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের কাছে ইংরেজি ও বড় বোন করিমন্নেসা বেগমের কাছে বাংলা ভাষা শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে শিক্ষা গ্রহণে ভারতবর্ষের মুসলিম নারীদের উন্মুখ করা এবং এক্ষেত্রে সে সময়ের পুরুষের গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার খণ্ডন হওয়া জরুরি। তাই তিনি মুসলিম নারী শিক্ষা বিস্তারে অবিস্মরণীয় ভূমিকা দিয়েছেন। বলা যায়, নেতৃত্বই দিয়েছেন। তার এই কাজে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তার স্বামী বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিপতœীক সাখাওয়াতকে বিয়ে করেন। আগের স্ত্রীর মৃত্যুতে সন্তানদের আপত্তির মুখেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে বিয়ে করেন।
বিয়ের পর রোকেয়া স্বামীর কাছে নতুন জীবন পান। মুসলিম নারীদের জন্য গঠনমূলক কিছু করার অনুপ্রেরণায় লেখালেখি করতে থাকেন গদ্য, উপন্যাস। পত্রপত্রিকায় প্রকাশও হতে থাকে। ‘মতিচুর’, ‘অবরোধবাসিনী’ ছিল তার গদ্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে উঠে এসেছে, মুসলিম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থা, বিবি তালাকের কঠিন ফতোয়ায় নারীর করুণ চিত্র। তার লেখা পড়ে মুসলিম নারীরা জেগে উঠতে থাকে। তার ক্ষুরধার কলমে উঠে আসতে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার, প্রগতিশীল আদর্শ। চিত্রিত হতে থাকে দীর্ঘদিনের চাপা পড়া অধিকারহারা নারীর ক্রন্দন, আর্তস্বর। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে লেখেন রোকেয়া। এটি প্রকাশ হয় ১৯০৫ সালে। এই উপন্যাসে নারী অধিকারের দিকটি চিত্রিত করেছেন তিনি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে একজন মুসলিম নারী কতখানি আধুনিক হলে নারীদের অধিকার নিয়ে কলম হাতে নিতে পারেন- তা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উপন্যাস না পড়লে বোঝা যাবে না। যে সমাজে, যে সময়ে নারী কেবল পুরুষের ‘ভোগের সামগ্রী’ হিসেবে বিবেচিত হতো, যখন নারীদের মানবিক সত্তার স্বীকৃতি তো দূরের কথা, তাদের অধিকারটুকুই দিতে অস্বীকৃত ছিল বাঙালি মুসলিম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, সেখানে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি এনেছেন তার উপন্যাসে। ইংরেজিতে প্রকাশের পর উপন্যাসটি ১৯২২ সালে রোকেয়া নিজেই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন (পৃষ্ঠা: ১০২, রোকেয়া-রচনাবলী)।
উপন্যাসটিতে নারীদের ভোটাধিকার, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার অধিকারসহ নানা তদানীন্তন কল্পনানির্ভর বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যা ওই সময় অকল্পনীয় ছিল, তাই তিনি তুলে ধরেছেন সবিস্তারে। নারীর উপেক্ষিত সর্বজনীন অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে এমন প্রাঞ্জল লেখা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিরল। ‘সুলতানার স্বপ্ন ইংরেজিতে প্রকাশের ১৬ বছর পর এই বই নিয়ে ‘সাধনা’ পত্রিকায় মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া লেখেন, ‘এর পাঠকগণ স্ব স্ব পরিবারের নারীগণকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করিতে চেষ্টা করিবেন’ (পৃষ্ঠা: ৬২৬, রোকেয়া-রচনাবলী)।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসটিকে বাংলা সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞান হিসেবে ধরা হয়। কেননা এতে নারী অধিকারের যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন, তা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিরল। ১৯৩২ সালে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় কবি আবদুল কাদির রোকেয়ার নারী ভাবনাকে ‘ব্যঙ্গরসাত্মক রচনা’, ‘নারীস্থানের এক অদ্ভুত পরিকল্পনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন (পৃষ্ঠা: ৬০৩, রোকেয়া-রচনাবলী)।
‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাস এবং ‘মধুর প্রতিশোধ’
স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কিছুদিন তিনি এক সরকারি সফরে গেলে ইংরেজিতে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাস লেখায় হাত দেন রোকেয়া। স্বামী ফিরে এলে স্ত্রী রোকেয়ার কাছে জানতে চান, ‘আমি ছিলাম না। এতদিন কি করলেন?’ জবাব রোকেয়া তার কর্মযজ্ঞের কথা জানান। তখন খোশ মেজাজে স্বামী বলে ওঠেন, ‘এ তো দেখছি মধুর প্রতিশোধ।’
‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাস ইংরেজিতে লিখে সেই পাণ্ডুলিপি সংশোধনের জন্য ভাগলপুরের ব্রিটিশ কমিশনার ম্যাকফারসনের কাছে পাঠান তিনি। কিন্তু বিন্দুমাত্র সংশোধন না করেই ম্যাকফারসন মন্তব্য করেন, ‘ইহাতে যে ভাব প্রকাশ করা হইয়াছে তাহা অত্যন্ত আনন্দপ্রদ ও স্বকীয় এবং তা লেখা হয়েছে নির্ভুল ইংরেজিতে। আমি ভাবছি ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে আমরা বায়ু-পথে কীরূপে ভ্রমণ করিব তিনি তাহার অগ্রিম বার্তাই দিয়াছেন। এই ব্যাপারে তাহার পরামর্শটি (কল্পনাটি-লেখক) সবচেয়ে অসাধারণ’ (বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল, বেগম রোকেয়া পৃষ্ঠা: ২৯২)। সেই উপন্যাসই প্রকাশ হয় ১৯০৫ সালে। এরপর তিনি নিজেই তা বাংলায় অনুবাদ করেন ১৯২২ সালে।
রোকেয়ার এই উপন্যাস পড়লেই বোঝা যায়, পাঠ প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় এনে পরবর্তী ইংরেজি ও বাংলা সংস্করণগুলো পরিবর্ধন করেছিলেন তিনি। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে সমাজে পুরুষ কর্তৃত্বের বিষয়টি খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি পুরুষদের অকর্মণ্য, অলস, মূল্যবোধহীন, বলে বেশি ও করে কম, মোটা বুদ্ধি, নারীর মেধা ও মূল্য বুঝতে অক্ষম এবং শান্তির সহজ উপায় থাকলেও যুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রাণ ও সম্পদ ক্ষয়কারী-এই ৭ ভাগে ভাগ করেছেন।
নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণে রোকেয়া
ভারতবর্ষে নবজাগরণে নারী শিক্ষাক্ষেত্রে একদিকে ভগিনি নিবেদিতা, স্বামী বিবেকানন্দ যেমন ভাস্বর হয়ে আছেন, অন্যদিকে মুসলিম নারী সমাজের বিদ্যাশিক্ষায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদানও কিছুমাত্র কম নয়। ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুও নারী শিক্ষায় ব্রতী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে অবদমিত করতে পারেনি। এগিয়ে গেছেন তিনি নতুন চিন্তাধারায়। অটল থাকেন নিজ লক্ষ্যে।
স্বামীর মৃত্যুর ৫ মাসের মাথায় বিহারের ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন একটি গার্লস স্কুল। মাত্র ৮ জন ছাত্রীকে নিয়ে স্কুলটির যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। ৪ বছরের মধ্যেই স্কুলটির ছাত্রী সংখ্যা ৩৪ জনে উন্নীত হয়। স্বামীর নাম চিরস্মরণীয় করে রাখতে স্কুলটির নাম দেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। কিন্তু এক বছরের মাথায় সম্পত্তিকেন্দ্রিক জটিলতার কারণে স্কুলের কাজে বাধা পান তিনি।
এরপর তিনি ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ স্কুলটি আবারও চালু করলেন। মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাব্রত নিয়ে স্কুল নির্মাণকে কেন্দ্র করে রোকেয়াকে তদানীন্তন ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাকে। উঠেছিল পর্দা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। সে জন্য মুসলিম মেয়েদের পর্দা রক্ষার্থে তাদের বাড়ি বাড়ি ভ্যানগাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন রোকেয়া। নারী শিক্ষা বাস্তবায়নে এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।
এছাড়া, বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণে ১৯১৬ সালে তিনি গঠন করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি নারী মৈত্রীমূলক সংগঠন। এর মধ্য দিয়ে নারী নেত্রী হিসেবে পরিচিত পেতে থাকেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনার করে নারী শিক্ষায় নারীদের সচেতন করার মানসে এবং নিজের আদর্শকে উপস্থাপন করার বিষয়টি উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশের নারী শিক্ষার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারী শিক্ষার ব্রত নিয়ে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মতান্তরে ৮ ডিসেম্বর প্রয়াত হন নারী শিক্ষার ইতিহাসে অগ্রবর্তী ও পথিকৃৎ এই কাণ্ডারি।