ব্যবস্থা নিতে দুদকের চিঠি: ভ্যাট ও করের ৬ কোটি টাকা জিপিও কর্মকর্তাদের পকেটে!

প্রকাশিত: ৯:৫৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩

 

সেলিনা আক্তার :
ভ্যাট ও করের ৬ কোটি টাকা জিপিও কর্মকর্তাদের পকেটে!
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের আওতাধীন ঢাকা জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও) থেকে প্রায় ছয় কোটি টাকার ভ্যাট ও কর লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। নকল চালান ব্যবহার করে ‘মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পে’র বিল থেকে এ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

২০১৯ সালে আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার প্রমাণ পাওয়ার পর জিপিও’র তৎকালীন হেড ট্রেজারার মো. এমদাদুল ইসলাম ভূঞাকে আসামি করে ২০২১ সালে মামলা দায়ের করা হয়। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্মকর্তারা আড়ালে থেকে যান। মামলা দায়ের হওয়ার দুই বছর পর ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবকে পাঠানো চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চিঠিতে দায়িত্বের চরম অবহেলার কারণে তৎকালীন পোস্টাল অপারেটর ও সহকারী ট্রেজারার (ট্রেজারি পার্ট-৩) স্বদেশ চন্দ্র দেব ও ঢাকার সহকারী পোস্টমাস্টার কাম পোস্টমাস্টার (ট্রেজারি) মো. আবুল বাসার আহমেদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুদক তার আইন ও বিধি অনুসারে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এর বাইরে অনেক সময় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়, যা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।

অভিযোগের বিষয়ে তখনকার সহকারী পোস্টমাস্টার কাম পোস্টমাস্টার (ট্রেজারি) ও বর্তমান সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল (নিরাপত্তা ও কল্যাণ) হিসেবে কর্মরত আবুল বাসার বলেন, ঘটনার পরপর আমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যতটুকু জানি মামলা চলমান রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানের সময় আমার বক্তব্য নেওয়া হয়েছিল। মামলার সর্বশেষ অবস্থা কিংবা চিঠির বিষয়টি আমার জানা নেই।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও দুদক সূত্রে জানা যায়, ঢাকা জিপিও’র ‘মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পে’র মঞ্জুরিকৃত একাধিক বিল থেকে ভ্যাট ও আইটি বাবদ কর্তনকৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান না করে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে- এমন অভিযোগে ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট জিপিও’র তৎকালীন হেড ট্রেজারার মো. এমদাদুল ইসলাম ভূঞার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/ এবং তৎসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ জুন দুটি আলাদা চালানে মোট পাঁচ কোটি ৯৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না করে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাল চালান তৈরি করে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।

১১ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি, প্রশ্নবিদ্ধ ঢাকা টোব্যাকো!
বদলি-পদোন্নতি বাণিজ্যে কোটিপতি স্বাস্থ্যের ক্লার্ক!
বকেয়া রাজস্বের জালে আটকা ২৪ হাজার কোটি টাকা
সূত্রটি আরও জানায়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সব দপ্তরের মঞ্জুরিকৃত বিল ঢাকা জিপিও থেকে পরিশোধ করা হয়ে থাকে। বিলের ওপর যথাযথ কর্তৃপক্ষের মঞ্জুরিপত্রে প্রদর্শিত সরকার নির্ধারিত ভ্যাট ও আইটি কর্তন করে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের বায়তুল মোকাররম শাখায় জমা দেওয়া হয়। সেখানে ঢাকা জিপিওর প্রধান কোষাধ্যক্ষ ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালের ৫ মে ঢাকা জিপিওর তদানীন্তন প্রধান কোষাধ্যক্ষ এমদাদুল ইসলাম ভুঞাকে ‘মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ প্রকল্প’ থেকে একই বছরের ২৮ এপ্রিল মঞ্জুরিকৃত একাধিক বিল থেকে ভ্যাট ও আইটি বাবদ কর্তনকৃত ১৪ কোটি ৮০ লাখ ৮ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু দীর্ঘ প্রায় চার মাসেও ওই টাকা জমা দেওয়ার চালানের কপি না পাওয়া সত্ত্বেও পোস্টাল অপারেটর ও সহকারী ট্রেজারার (ট্রেজারি পার্ট-৩) স্বদেশ চন্দ্র দেব বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি। টাকা গ্রহণের প্রায় চার মাস পর এমদাদুল ইসলাম দুটি বিতর্কিত চালানসহ মোট ১৬টি চালানের কপি স্বদেশ চন্দ্র দেবকে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু চালানগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় সরকারের ভ্যাট ও আইটি বাবদ জমা দেওয়া ১৪ কোটি ৮১ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৪ টাকার মধ্যে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকার দুটি চালান জাল ও ভুয়া। দীর্ঘদিন নিজ হেফাজতে রেখে বিষয়টি গোপন করার সুবাদে ওই টাকা আত্মসাতের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বদেশ চন্দ্র দেব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত না করায় তার ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি বলে মনে করছে দুদক।

হাজার কোটি টাকার সার লোপাট, ফের বিপাকে এমপি পোটন
অন্যদিকে, তদন্তকালে আরও দেখা যায় সহকারী পোস্টমাস্টার কাম পোস্টমাস্টার (ট্রেজারি) মো. আবুল বাসার আহমেদ ঢাকা জিপিও’র ট্রেজারির সকল শাখার তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার দায়িত্বকালীন সময়ে তারই অধীন সহকারী ট্রেজারার স্বদেশ চন্দ্র দেব জিপিও’র ভ্যাট ও আইটি কর্তনের ১৪ কোটি ৮১ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৪ টাকা জমা দেওয়ার জন্য এমদাদুল ইসলাম ভূঞাকে বুঝিয়ে দেন।

কিন্তু ভ্যাট ও আইটি’র টাকা নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকে জমা হলো কি না এবং চালানের কপি সহকারী ট্রেজারার আবুল বাসার বুঝে পেয়েছেন কি না তা তিনি যথাযথ উপায়ে তদারকি করেননি। ইতোমধ্যে ভ্যাট ও আইটি’র ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তৎকালীন হেড ট্রেজারার এমদাদুল ইসলাম ভূঞার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু বাকি দু’জনের ওপর অর্পিত দায়িত্বের চরম অবহেলা অদক্ষতা ও বিশ্বাসভঙ্গের শামিল। তাদের এমন কার্যকলাপের জন্য তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এই অবস্থায় তৎকালীন পোস্টাল অপারেটর ও সহকারী ট্রেজারার (ট্রেজারি পার্ট-৩) স্বদেশ চন্দ্র দেব ও ঢাকার সহকারী পোস্টমাস্টার কাম পোস্টমাস্টার (ট্রেজারি) মো. আবুল বাসার আহমেদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করেছে দুদক। মামলার আসামি এমদাদুল ইসলাম ভূঞা বর্তমানে অবসরে রয়েছেন বলে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে।